২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ তম দিনে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনগুলো রিজার্ভ, ব্যাংক খাত এবং মূল্যস্ফীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রভাব ফেলেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলির মধ্যে কিছু ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে, দেশের রিজার্ভ সংকট, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগের পরও পরিস্থিতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়নি। চলুন, এসব বিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা যাক।
রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স:
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত কয়েক বছর ধরেই সংকটে রয়েছে। বিশেষত, ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভ সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল, যা দাঁড়িয়েছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। তবে কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার পাচার পরিস্থিতির কারণে রিজার্ভে ধীরে ধীরে পতন ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য রিজার্ভ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এটি দেশের আমদানি খরচ মেটানো এবং বৈদেশিক লেনদেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, অন্তর্বর্তী সরকার রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ছিল ১৩৩ কোটি ডলার, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় ২৪০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, এর মূল কারণ হচ্ছে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন, যা রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স ফ্লো বাড়ছে, যা রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে।” তিনি আরও বলেন, “ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে। আগে যেখানে প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ১৭০ কোটি ডলার আসতো, এখন তা ২০০ কোটি ডলারের উপরে চলে গেছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, “সরকার যদি অফিশিয়াল চ্যানেলে মুদ্রা পাঠানোর ক্ষেত্রে যে রেট নির্ধারণ করেছে, তা বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাখা যায়, তাহলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ আরও বাড়ানো সম্ভব হবে।”
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানান, রিজার্ভের সংকট মোকাবিলায় সরকার কোনো ধরনের ‘হস্তক্ষেপ’ বা ‘রিজার্ভে হাত দেয়া’ প্রয়োজন হয়নি, যা রিজার্ভের প্রতি কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে।
ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি:
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে একটি সংকটকালীন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন ‘সবল’ এবং ‘দুর্বল’ এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। কয়েকটি ব্যাংক অনাদায়ী ঋণ ও খেলাপি ঋণের কারণে বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়েছে। এর ফলস্বরূপ, দেশের ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। গত কয়েক মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে। পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন ব্যাংককে তারল্য সংকট মোকাবিলায় বিশেষ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেয় এবং সেপ্টেম্বর মাসে তা পুনরায় তুলে নেয়। তবুও কিছু ব্যাংক এখনও তারল্য সংকটে ভুগছে এবং গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা সরবরাহ করতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চলতি হিসেব প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা গেছে ব্যাংকগুলোতে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এদিকে, সাতটি দুর্বল ব্যাংককে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা জানিয়েছেন, “এই তারল্য সহায়তা কোনো অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে দেয়া হয়নি। বরং সবল ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।”
তবে, অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, “এই ধরনের সাময়িক পদক্ষেপ ভবিষ্যতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারবে না। কারণ, ব্যাংক খাতের দুর্বলতার মূল কারণগুলো এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।”
মূল্যস্ফীতি ও সরকারের পদক্ষেপ:
বাংলাদেশের মানুষের জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতি সামলাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত অসন্তোষ প্রকাশ করছেন।
অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০.৮৭ শতাংশে, যা গত মাসে ছিল ৯.৯২ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি, যা দাঁড়িয়েছে ১২.৬৬ শতাংশ। পেঁয়াজ, ডিম, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে।
সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেমন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রানীতির পরিবর্তন এবং শুল্ক কমানো। পেঁয়াজ ও ডিমের মতো খাদ্যপণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং আমদানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।
তবে, অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, “যেকোনো ধরনের দাম বেধে দেওয়া বা মার্কেট তদারকির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। কারণ, এটি কেবল লোক দেখানোর জন্য করা পদক্ষেপ।”
তিনি আরও বলেন, “যে ধরনের প্রকৃত পদক্ষেপ নিতে হবে তা হচ্ছে পাইকারি বাজারে সঠিক তথ্য তুলে ধরা, যাতে মানুষ জানে কোন পণ্য কোথায় কী দামে পাওয়া যাবে।”
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “মুদ্রানীতির সুফল পেতে কমপক্ষে এক বছর লাগবে। চার মাস পার করার পর, মূল্যস্ফীতি কমাতে আরও আট মাস সময় প্রয়োজন।”
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশের অর্থনীতি, ব্যাংক খাত ও রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করার জন্য আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান খোঁজা প্রয়োজন।