বরিশাল অফিস :: বরিশালের সবচেয়ে অবহেলিত জনপদ হিসেবে হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও মুলাদি উপজেলার নাম এখন সর্বজন স্বীকৃত।
শুধু বংশ পরম্পরায় ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের খুনখারাবি বা মারামারির জন্যই নয়, নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের হাহাকারের জন্যেও এ অঞ্চল সমান প্রসিদ্ধ এখন।
রাত নামলেই গৃহবন্দী জীবন ::
মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, স্কুল ছাড়াও অসংখ্য বসতভিটা, ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে এ অঞ্চলে মেঘনা নদীর ভাঙনে। তারউপর রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার সংকট। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পরলে তাকে সুচিকিৎসার জন্য নিতে হবে বরিশালের শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শেবাচিম এ। কিন্তু সেজন্য সহজে যাতায়াতের কোনো উপায় নেই। অসংখ্য পোয়াতি মা এই হাসপাতালে পৌছানোর আগেই হয় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, নয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন বলে জানা গেল তিন উপজেলার প্রায় প্রতিজন মানুষের মুখে।
এরমধ্যে সবচেয়ে করুন ও মানবিক জীবনযাপন মেহেন্দিগঞ্জের মানুষের। চারদিকে যাদের অথই জলের পাহারা। রাত নামলেই গৃহবন্দী জীবন। ফেরী বা ট্রলারে নদী পার হলে তবেই ওপারে হিজলা ও মুলাদি উপজেলা। এ দুটি উপজেলা পাশাপাশি এবং একই সড়কে, একই সমস্যায় জর্জরিত তারা। এখানে আড়িয়াল খা এবং মেঘনা নদী শহরের সাথে এই দুই উপজেলাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। অন্যদিকে হিজলা এবং মেহেন্দিগঞ্জ নিয়ে বরিশাল ৪ আসনটি গঠিত। ফলে হিজলার সাথে মেহেন্দিগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নদী ভাঙন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই হিজলার তিনপাশে এবং মুলাদির একপাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন এ অঞ্চলের বাসিন্দারা।
বাবুগঞ্জ ও মুলাদি উপজেলা বরিশাল ৩ সংসদীয় আসন। বর্তমান সংসদ সদস্য বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন। বাবুগঞ্জের সন্তান রাশেদ খান ইতিপূর্বেও এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন তবে নিজ এলাকার উন্নয়নেই কখনো কোনো ভূমিকা নেননি বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সেখানে মুলাদির মানুষের জন্য তিনি কিছু করবেন বলে বিশ্বাস করতে চাননা মুলাদিবাসী। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিঠু জানালেন, এই যাতায়াত সংকটের কারণে মুলাদির বেশ কয়েকজন রোগী হাসপাতালে যাওয়ার আগেই মারা গেছে। এখানে মীরগঞ্জ সেতু তৈরির পরও ওপারে বাবুগঞ্জ লাকুটিয়া সড়কটি মেরামত না হলে ভোগান্তি কমবে না বলে জানান মিঠু।
কৃষি এবং নদীতে মাছ শিকার এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবীকা। বলা যায়, জেলে অধ্যুষিত অঞ্চল এই মুলাদি, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা। তিন উপজেলার লোকসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ হবে বলে অনুমান করেন মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান এ,কে,এম মাহফুজ উল আলম। তিনি বলেন শুধু মেহেন্দিগঞ্জের জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ। ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে আমরা যে এখনো বেঁচে আছি এটাই সপ্তাশ্চর্য।
মেহেন্দিগঞ্জের যোগাযোগ সবটাই নদী পথে। আর হিজলা উপজেলার মানুষের জন্য সড়ক পথ রয়েছে। তবে তা মুলাদির খেয়াঘাট পর্যন্ত। নদী পথে বরিশাল থেকে সরাসরি স্পিডবোটে তিন উপজেলাতেই আসাযাওয়া সম্ভব হলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে জানালেন হাতেম আলী কলেজে অধ্যায়নরত হিজলার বাজার টেক এলাকার বাসিন্দা রেদোয়ান।
তিনি বলেন, গরীব বা মধ্যবিত্ত কিম্বা ধনী, আমাদের সবাইকে বাজার-সদাই করতে, চাকরি, পড়াশুনা করতে বরিশাল শহরে যেতেই হয়। শহরে যেতে হলে হিজলা থেকে মহেন্দ্র বা অটোরিকশা নিয়ে মুলাদির কাজীচর খেয়াঘাট যেতে হবে। সেখান থেকে খেয়া পার হয়ে ওপারে মীরগঞ্জ। মীরগঞ্জ থেকে অটোরিকশা বা ইজিবাইক নিয়ে বাবুগঞ্জের রহমতপুর যেতে হবে। আগে তাও লাকুটিয়া দিয়ে যাতায়াত করা যেত। কিন্তু ঐ সড়ক এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পরে আছে। আমাদের তাই আরো ঘুরে রহমতপুর থেকে বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় পৌঁছাতে কম হলেও দুই আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে এখন।
বরিশাল থেকে হিজলা উপজেলা পরিষদে এসে পৌঁছাতে মোটরসাইকেল নিয়ে এই প্রতিবেদকেরও দেড়ঘন্টার মতো সময় লেগেছে মাত্র ৪০ কিলোমিটার পথের দুরত্ব পেরোতে।
তিনপাশে নদী, একপাশে সড়ক চলে গেছে মুলাদির কাজীরচর খেয়াঘাট পর্যন্ত। চারিদিকে ভাঙনের চিত্র এখানে। বেড়িবাঁধ এলাকায় বাঁধের উপরই অসংখ্য ঘরবাড়ি চোখে পড়ে। টেকের বাজার বা বাজার টেক পার হয়ে দক্ষিণে বড়জালিয়া ইউনিয়নের বাউসিয়া গ্রাম। মেঘনা নদীর পাড়ে এখানে ২০০ মিটার এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে নদী ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে। নদী তীরবর্তী বাউসিয়া গ্রামের মানুষ তাই অনেক খুশি। স্থানীয় সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ ও শাম্মী আহম্মেদ এর প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, এই ব্যাগ যদি ফেলা না হতো তাহলে এবছরের মধ্যে হিজলা উপজেলা পরিষদ এলাকাও নদীতে বিলুপ্ত হয়ে যেত।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ঝন্টু হাওলাদার সহ কয়েকজন গ্রামবাসী আরো বলেন, এই জিও ব্যাগ হয়তো সাময়িক ভাবে ভাঙন রোধে সাহায্য করবে তবে নদীর দুই পাড়ে বরিশালের চরকাউয়া ও চরবাড়িয়া বেড়িবাঁধের মতোই বাঁধ নির্মাণের দাবী করেন তারা। একইসাথে মীরগঞ্জ সেতু তৈরির প্রতিশ্রুতি রক্ষার দাবী জানান হিজলা উপজেলার বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ।
এখানে উপজেলা পরিষদ চত্বরে কথা হয় স্থানীয় সাংবাদিক ও হিজলা প্রেসক্লাবের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন এর সাথে। তিনি জানালেন, ইতিমধ্যেই ৫ টি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ঝুঁকির মুখে রয়েছে আরো অর্ধশত গ্রাম। পানি উন্নয়ন বোর্ড যদিও এখানে ৬২৮ কোটি টাকার কাজের বরাদ্দ দিয়েছেন। রীতিমতো নদী তীরবর্তী এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টাও শুরু হয়েছে। তবে ১০ টি প্যাকেজে এই কাজ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত একটি প্যাকেজের কাজই দৃশ্যমান বলে জানান সাংবাদিক দেলোয়ার।
এ বিষয়ে হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, নদী ভাঙন রোধে গৃহিত পদক্ষেপ আমার আসার পূর্বে হয়েছে। এ বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। কাজের মান নিয়েও কিছু বলতে পারবোনা। তবে মীরগঞ্জ সেতু নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এখন টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে। মীরগঞ্জ সেতু তৈরি সম্পন্ন হলে এ অঞ্চলের মানুষের ৮০ ভাগ ভোগান্তি দূর হয়ে যাবে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।