বরিশাল অফিস :: বরিশাল নগরে প্রথম ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মিত হয় ২০০৫ সালে ব্রাউন কম্পাউন্ড সড়কে। তখনকার সময়ে নগরে সবচেয়ে সুরম্য অট্টালিকাটির নাম দেওয়া হয় ‘বীরউত্তম ভবন’। বাড়িটিকে ঘোষণা করা হয় মুক্তিযোদ্ধা মিলনকেন্দ্র হিসেবে।
তবে এ ভবনে মাঝেমধ্যে শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা এসে বাস করতেন। তিনি হলেন এ অট্টালিকার মালিক ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত-সমালোচিত হন তিনি।
বছর তিনেক আগে নগরের বগুড়া সড়কে আরেকটি ডুপ্লেক্স নির্মাণ করেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আমির হোসেন আমু। দুটি অট্টালিকাই এখন পোড়া বাড়ি। ক্ষুব্ধ জনতা তাতে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করেছে।
এই দুই নেতার নির্বাচনী এলাকা ঝালকাঠি। এলাকায় গেলে তারা রাতযাপন করতেন এই বাড়িতে।
নগরীতে আওয়ামী লীগের আরও দুই নেতার বাসভবন পোড়াবাড়িতে পরিণত হয়েছে। তবে তাদের বাড়ি আমু ও ওমরের মতো দৃষ্টিনন্দন ছিল না। কালীবাড়ি সড়কে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বাড়িটি বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী। অপরদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগে হাসানাত বিরোধীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল নগরের নবগ্রাম সড়কে সদ্য সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের ‘বেগম ভিলা’।
এর মধ্যে ৩টি বাড়ি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এবং জাহিদ ফারুকের বাড়িটি আন্দোলন চলাকালেই বিক্ষুব্ধ জনতা ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছে। উৎসুক জনতা ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে আসছেন।
বীরউত্তম ভবন ::
বুধবার দুপুরে বাড়িটির সামনে গেলে প্রধান ফটক তালাবদ্ধ দেখা যায়। বাড়িটির ঠিক বিপরীত দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালকের দপ্তর। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরের ধ্বংসযজ্ঞ অনুমান করা যায়। ৩ তলা ডুপ্লেক্সে একটি গ্লাসও অবশিষ্ট নেই। সর্বত্র ভাঙচুর ও আগুনে পোড়ার চিহ্ন। পোড়া আসবাবপত্র এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভবনের বাইরে।
বাড়িটির তত্ত্বাবধায়ক জালাল আহমেদ দাবি করেন, দশ বছর আগে এ বাড়িটিতে চাকরি করেছেন। এখন করেন না। তবে চলাফেরা ও বাড়ির দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে বোঝা গেছে তিনিই দেখভালের দায়িত্বে আছেন। জালাল ও অন্য প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার বিকেলে তালা ভেঙে ভবনে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা।
আমুর বাড়ি ::
দেশের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অপসোনিন গ্রুপের মালিকের বাড়ি বরিশাল নগরের বগুড়া সড়কে। গ্রুপের চেয়ারম্যান সবুর খান ও তাঁর সহোদররা এবং আমু আপন খালাতো ভাই। জানা গেছে, এ বাড়ির দুইশ গজ দূরে অপসো স্যালাইন নামক প্রতিষ্ঠানটি ছিল আমুর পৈতৃক নিবাস। ছাত্র রাজনীতির জীবনে তিনি এ বাড়িতেই থেকেছেন। পৈতৃক ভিটিতে কয়েক দশক আগে অপসো স্যালাইন নির্মিত হলে আমু বরিশালে এলে সবুর খানদের বাড়িতে উঠতেন।
বছর তিনেক আগে বাড়ির সামনে সুরম্য ডুপ্লেক্স করেন আমু। নান্দনিক সৌন্দর্যে সাজানো হয় ভবনের ভেতর-বাইর। কিছুটা আড়ালে থাকা বাড়িটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পথচারীরা উঁকিঝুঁকি দিতেন। সোমবার বিকেলে এ আগুন দেয় ক্ষুব্ধ জনতা।
বুধবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায় বাড়িতে প্রবেশের প্রধান ফটক শেকল দিয়ে তালা লাগানো। নিরাপত্তাকর্মী ফজলু জানান, মঙ্গলবার রাতে সেনাবাহিনী এসে বাড়িটিতে তালা মেরেছে। ফটকের সামনে দাঁড়ানো স্থানীয় এক নারী জানান, সোমবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অচেনা মুখের কিশোর-যুবকরা এসে বাড়ির আসবাবপত্র নিয়ে গেছে।
সেরনিয়াবাত ভবন ::
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বাড়ি থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী থেকে আওয়ামী লীগের পুরো জেলা এবং দক্ষিণাঞ্চলের একাংশ নিয়ন্ত্রিত হতো। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বাড়িটিকে অনেকে বরিশালের ৩২ নম্বর বাড়িও বলতেন।
সোমবার বিকেলে বিক্ষুব্ধদের দেওয়া আগুনে তিনতলা বাড়িটি এখন ধ্বংসস্তূপ। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আগুন দেওয়া হলে রাত ৯টা পর্যন্ত জ্বলতে দেখা গেছে। বাড়ির সামনের ৪টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভস্মীভূত হয়েছে। দমকল কর্মীরা রাতে বাড়ির তিনতলা থেকে ৩ জনের পোড়া মৃতদেহ উদ্ধার করে। তার মধ্যে ২ জন সাদিক অনুসারী আওয়ামী লীগ কর্মী এবং একজন গৃহকর্মী বলে জানা গেছে। বুধবার ওই বাড়িতে প্রবেশের প্রধান ফটকে তালা মারা দেখা গেছে। সংলগ্ন সড়কের ব্যবসায়ীদের কেউ এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজী হননি।
বেগম ভিলা ::
নবগ্রাম সড়কের বেগম ভিলা নামের বাড়িটি জাহিদ ফারুক শামীম নির্মাণ করেন এক বছর আগে। পাঁচতলা ভবনটি থেকে তার রাজনৈতিক কার্যক্রম চলত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রোববার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিন দফা হামলা চালায় জাহিদ ফারুকের বাড়িতে। নিচতলায় দেওয়া আগুন তিনতলা পর্যন্ত ছড়িয়েছে। বাসায় থাকা কমপক্ষে ৩০টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।