পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: চলমান অসহনীয় গরমে যখন ‘গাছ লাগাও, পরিবেশ বাঁচাও’ আওয়াজ উঠেছে, ঠিক সে সময়েই পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে সামাজিক বনায়নের এক হাজার ৩৭৫টি গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। সামাজিক বনায়ন বিধিমালার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে তীব্র গরমের মধ্যেই ৬ কিলোমিটার সড়কজুড়ে ছায়া দেওয়া ২৪ বছরের পুরানো এসব গাছ কেটে নেওয়া হচ্ছে। এতে ছায়া বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ, ঠিকানা হারাচ্ছে পাখ-পাখালি। কিন্তু গাছ কাটার এমন সিদ্ধান্ত কিংবা নিয়ম জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য শুভকর নয়; বলছেন পরিবেশবিদরা।
সামাজিক বনায়নের এসব গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন বিভাগ। বন বিভাগের রাঙ্গাবালী রেঞ্জ কার্যালয় সূত্র বলছে, ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে রাঙ্গাবালী বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন সড়ক থেকে উপজেলা পরিষদ হয়ে গন্ডাদুলা এম এইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশে এ গাছগুলো রোপণ করা হয়েছিল। বন বিভাগের সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের আওতায় ২৪ বছর আগে সড়কটির দু’পাশে মেহগনি, রেইনট্রি, আকাশমনি, অর্জুন, খইয়া, বাবলা, চাম্বুল, শিশু, কড়াই, ঝাউ, পেয়ারা ও কাঁঠাল প্রজাতির এ গাছ রোপণ করা হয়।
বন বিভাগ বলছে, সামাজিক বনায়ন বিধিমালার অনুযায়ী ২০ বছর পূর্ণ হলেই সামাজিক বনায়নের গাছ নিয়মানুযায়ী বিক্রি করার বিধান রয়েছে। সেই নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে ফলজ-বনজ প্রজাতির এক হাজার ৩৭৫টি গাছ নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করে বিক্রি করার জন্য গত ১৩ ডিসেম্বর দরপত্র আহ্বান করে বন বিভাগ। ৫ লক্ষ ৮৩ হাজার ২০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মো. বশির মিয়া গাছ কাটার কার্যাদেশ পান।
আরো পড়ুন : সৎ, শিক্ষিত ও তরুণ নেতৃত্ব নির্বাচিত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে স্মার্ট, উন্নত ও মানবিক দুমকি বিনির্মানে সহযোগীতা চাইলেন মেহেদী হাসান মিজান
কিন্তু গরমে যখন হাঁসফাঁস জনজীবন, ঠিক তখনই গাছ কাটা শুরু হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, কাঠফাটা রোদে একটু প্রশান্তি মেলে গাছ তলাতে। কিন্তু মাথার ওপর ছায়া দেওয়া, পাখিদের আশ্রয় দেওয়া সেই গাছে ঢাকা সড়কটি এখন প্রায় গাছ শূন্য। একের পর এক কাটা পড়ছে ছায়া বৃক্ষগুলো। তাপদাহ চলা পুরো এপ্রিল মাসজুড়েই গাছ কাটা চলে। এখন প্রায় শেষ পর্যায়ও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জানান, বন বিভাগ যে গাছগুলোতে লাল নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করেছে তা-তো কাটা হচ্ছেই, আর যেগুলো নম্বর চিহ্ন দেয়নি তাও কাটা হচ্ছে। ছোট-ছোট গাছও রক্ষা পাচ্ছে না।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের গন্ডাদুলা গ্রামের খালিদ হোসেন বলেন, ‘দু’পাশের এ গাছগুলো সড়কটিকে ছায়া দিয়ে রাখতো। ছায়া দেওয়া এসব গাছের কোনটিই রাখা হচ্ছে না। ছোট-বড় সব গাছ কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। বন বিভাগের গাছ তো নিছেই, আমাদের অনেকের লাগানো মালিকানা গাছও কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এই সড়কে গাছ থাকলে ছায়ায় চলাফেরা করতে পারতাম। গাছ না থাকার কারণে রোদের তীব্রতা আরও বেড়ে গেছে। গরমে সড়কে চলাচল করতে পারছি না।’
ওই ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের বশার হোসেন বলেন, ‘এই রাস্তায় যখন গাছ ছিল, ঠান্ডা বাতাস লাগতো। গাছ কেটে ফেলছে, এখন রোদে চলা যায় না। পথচারীরা গাছের ছায়া পাচ্ছে না। গাছগুলোতে আশ্রয় নেওয়া পাখিগুলো আশ্রয় হারাচ্ছে। এই সড়কে শোনা যাবে না পাখির কিচিরমিচির শব্দ।’
বন বিভাগের রাঙ্গাবালী রেঞ্জ কর্মকর্তা অমিতাভ বসু বলেন, ‘দারিদ্র বিমোচন করতে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা অনুযায়ী উপকারভোগীদের সম্পৃক্ত করে সমিতির মাধ্যমে সৃষ্ট সামাজিক বনায়নের গাছ রোপণের ২০ বছর পর কেটে নিয়মানুযায়ী বিক্রি করার বিধান রয়েছে। বিক্রি করা এই অর্থ বন অধিদপ্তর ১০ শতাংশ, ভূমি মালিক সংস্থা ২০ শতাংশ, উপকারভোগী ৫৫ শতাংশ, পুনরায় বাগান করার জন্য ১০ শতাংশ এবং ইউনিয়ন পরিষদ পাবে ৫ শতাংশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে সড়ক থেকে গাছ কাটা হচ্ছে সেই সড়কে পুনরায় ১০ হাজার গাছ রোপণ করা হবে।’
তবে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা রক্ষার নামে গাছ কাটার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করছেন পরিবেশবিদরা।
পরিবেশবিদরা বলছেন, সামাজিক বনায়ন বিধিমালার এই নিয়ম এখন পরিবর্তন প্রয়োজন। এমন নিয়ম করতে হবে যে গাছ কেটে উপকারভোগীদের আর টাকা দেওয়া হবে না। গাছের পরিচর্যা কিংবা দেখাশোনা করার দায়িত্ব থাকা উপকারভোগীদের অন্য ধরণের সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনভাবেই গাছ কাটা যাবে না। গাছ কাটা পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকির বলে মনে করছেন তারা।
আরো পড়ুন : পটুয়াখালীতে বালুচাপা দেয়া হাত-পা বাঁধা অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধার
এ প্রসঙ্গে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. মো. শাহরিয়ার জামানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ‘আমাদের দেশে বনায়নের পরিমাণ অত্যন্ত কম। এটা ১২ দশমিক ৮ কিংবা হিসেব করলে এর চেয়ে আরও কম। যেটার কুফল কিন্তু এখন আমরা ভোগ করছি। আমাদের দেশের ওপর দিয়ে হিটওয়েভ বয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রিও ছাড়িয়েছে। যেটা ১০-১৫ বছর আগেও ছিল না।’
ড. মো. শাহরিয়ার জামান বলেন, ‘উপকূলীয় রাঙ্গাবালী এমনিতেই খরা, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার মতো দুর্যোগের সম্মুখীন। সুতরাং সামাজিক বনায়নের যে গাছগুলো বন বিভাগ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা পরিবেশগত হানিকর সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই না। বন বিভাগই যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরা কার প্রতি আস্থা রাখবো?। আমি মনে করি বন বিভাগ এমন সিদ্ধান্ত থেকে দ্রুত সরে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সামাজিক বনায়নের সুফল ভোগ করে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজন। এর সুফল ভোগ করে সেখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। সুতরাং এ গাছগুলো কেটে ফেলা বা সরিয়ে ফেলা মানে ওখানকার তাপমাত্রা এমনেতেই বেড়ে যাবে। ওই জায়গার জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে। এছাড়া ১৫-২০ বছরের পুরনো গাছ যদি কেটে ফেলা হয়, সে অবস্থায় আবার ফিরে আসতে ১৫-২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।’