পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ পটুয়াখালীর আরিফুলের জন্য মির্জাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। পাশাপাশি তিনি সুস্থ হলে তাঁকে কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
আজ শনিবার দুপুর ১২টার দিকে আরিফুলের খোঁজ খবর নিতে গ্রামের বাড়ি নতুন শ্রীনগরে আসেন মির্জাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তেন মংকে। এ সময় তিনি আরিফুলকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর ‘ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে আহত আরিফুল এখন শয্যাশায়ী, চিকিৎসা খরচ বহনে অনিশ্চয়তা’ শিরোনামে একাধিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ বিষয়টি মির্জাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তেন মংকে অবহিত করা হয়।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আজ আরিফুলের গ্রামের বাড়ি এলে তাঁকে পায়ের বিভিন্ন সমস্যা অবহিত করেন আরিফুল। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সময় নিয়ে তাঁর সমস্যাগুলো শোনেন। এরপর তিনি ঢাকায় অর্থোপেডিক হাসপাতালের চিকিৎসার রিপোর্টগুলো দেখেন এবং তাঁকে ব্যবস্থাপত্র দেন।
মিরপুর–১০ নম্বর গোলচত্বরে ভ্যানে আঁতর ও টুপি বিক্রি করতেন আরিফুল ইসলাম (২১)। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন মিরপুরেই। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। এদিন বাঁ পায়ে চারটি গুলি লাগে তাঁর। এরপর থেকেই শয্যাশায়ী আরিফুল।
আরিফুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার মাধবখালী ইউনিয়নের নতুন শ্রীনগর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মো. হারুন অর রশিদের ছেলে।
আরিফুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরোনো একটি টিনশেড ঘরে আরিফুল খাটে শুয়ে আছেন। বাঁ পায়ে ব্যান্ডেজ ও গুলির ক্ষতস্থান। পা নাড়াচাড়া করতে পারছেন না। অসুস্থ বাবার পাশেই তিন মাসের সন্তান আরাফ হোসেন ঘুমিয়ে আছে। আরিফুলের বাড়িতে অনেক লোকজনের সমাগম দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিবেশী ও বন্ধুরা প্রতিদিনই তাঁকে দেখতে আসছেন।
আরিফুল বলেন, ‘অভাবের সংসারে বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি। সংসারের ভার কাঁধে নিয়ে পাঁচ বছর আগে কাজের সন্ধানে ঢাকায় যাই। এক বন্ধুর সহায়তায় মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে ভ্যানে করে আঁতর টুপি বিক্রি শুরু করি। এতে যে লাভ হতো বাড়িতে মা-বাবা ও ভাইদের জন্য খরচ পাঠাতাম। দুই বছর আগে আমি বিয়ে করি। তিন মাসের একটি ছেলেসন্তান রয়েছে।’
আরিফুল আরও বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ১৮ জুলাই থেকে মিরপুর গোলচত্বরে ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে শরিক হই। কারফিউয়ের মধ্যে ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে বাসা থেকে বের হই। মিরপুর আইডিয়াল গার্লস স্কুলের পেছনের গলিতে এসে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতার সঙ্গে একত্র হই। বিকেল ৪টায় আমরা গলি থেকে মিছিল নিয়ে মিরপুর–১০ নম্বর গোলচত্বরের দিকে যাই। সেখানে তখন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিল। সেনাবাহিনীর সামনেই আমরা মিছিল দিতে থাকি। গোলচত্বর থেকে কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনী চলে যায়। এরপরই ফায়ার সার্ভিস ভবনের ওপর থেকে আমাদের মিছিলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘মুহূর্তেই সেখানে এক শিশুসহ পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ ১০ বছরের শিশুটিকে আমি তুলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে চাইলে বাঁ দিক থেকে চারটি গুলি এসে আমার পায়ে লাগে। এর মধ্যে দুটি গুলি পা ছিদ্র হয়ে বের হয়ে যায়। পরে ছাত্ররা অ্যাম্বুলেন্স এনে আমাকে মিরপুর ১১ নম্বর ইসলামিয়া হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আগারগাঁও অর্থোপেডিক হাসপাতালে ভর্তি করেন। ছাত্রদের কাছে স্বজনদের মোবাইল নম্বর দিলে বিষয়টি স্বজনদের জানান। এরপর স্বজনেরা হাসপাতালে আসেন। এদিন হাসপাতালের খরচ আমাদের চালাতে হয়। এতে প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। এরপরের চিকিৎসা ছাত্ররাই বহন করেন।’
আরিফুলের মা শামীমা বেগম কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘ছেলেটা অমার পঙ্গু হয়ে গেছে। এ পা দিয়ে আমার ছেলে মনে হয় আর হাঁটতে পারবে না। কীভাবে আমাদের সংসার চলবে। ওর বাবা যে আয় করে তাতে আমাদের সংসার চলে না। মেজ ছেলে হাসিব বেতাগী লক্ষ্মীপুরা আলিম মাদ্রাসায় আলিম দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। সেজ ছেলে হামিম বাজিতা ছালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে তামিম নতুন শ্রীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। ওদের লেখাপড়া ও অসুস্থ বড় ছেলে আরিফের চিকিৎসার খরচ কোথায় পাব?’
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তেন মং বলেন, ‘বিষয়টি জেনে আমরা আরিফুলের বাড়িতে গিয়ে তাঁর খোঁজ-খবর নিয়েছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসার জন্য তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। কাঠালতলী ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের উপসহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. রিয়াজুল ইসলামকে সার্বক্ষণিক আরিফুলের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ আরিফুলের বাড়িতে গিয়ে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকার একটি অনুদানের চেক পরিবারের কাছে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকার একটি আবেদন পাঠানো হয়েছে। এ টাকাও তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে পেয়ে যাবেন। গত মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) চিকিৎসার জন্য প্রবাসী অ্যাম্বুলেন্সে বিনা খরচে তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে তিনি চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন। শারীরিকভাবে তিনি সুস্থ হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরিফুলের বাড়িতে আসার সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মুহা. উমর ফারুক জাবির, কাঠালতলী ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের উপসহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. রিয়াজুল ইসলাম ও স্বাস্থ্য পরিদর্শক মো. জহিরুল ইসলাম।