বরিশাল অফিস :: রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ চালতা ফুলের রূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন- ‘আমি চলে যাব বলে/ চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে/ নরম গন্ধের ঢেউয়ে?’
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে চলতি বর্ষায় কেয়া ও কদমফুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটেছে চালতাফুলও। পথের ধারে কিংবা পুকুর পাড়ে দৃশ্যমান এ চালতার দৃষ্টিনন্দন ফুল ও সৌরভ বিমোহিত করছে সৌন্দর্যপিপাসু পথিকদেরকেও।
সাদা রঙের সুরভিত ওই ফুলের ব্যাস ১৫-১৮ সেন্টিমিটার। মূলত গ্রাম-গঞ্জে বর্ষাকালে দেখা মেলে চালতা ফুল ও ফলের। দৃষ্টিনন্দন এই ফুলটি বর্ষা মৌসুমে গাছের শাখায় ফুটে কেবল আবহমান প্রকৃতির শুদ্ধতারই জানান দেয়।
সূত্রমতে, ঔষধিগুণসম্পন্ন ও টক জাতীয় চালতা ফলের কদর রয়েছে দেশের সর্বত্রই। এ গাছটি উচ্চতায় প্রায় ১৮ মিটার পর্যন্ত বড় হয়ে থাকে। গাছটির শাখা-প্রশাখা অবিন্যস্ত ও প্রসারিত। সবুজ পাতাগুলো খাঁজকাটা ধরনের হয়। বর্ষায় ওই সবুজের মাঝে শুভ্র চালতা ফুল দেখতে বেশ আকর্ষণীয় লাগে। দীর্ঘাকার ঘন পাতার আচ্ছাদনে এ ফুলকে আড়াল করে রাখে। এর বৃতির রঙ সবুজ ও স্থায়ী। সুমিষ্টি গন্ধযুক্ত এ ফুলের পরাগধানী কাঁচাহলুদ রঙের পুংকেশরে মণ্ডিত।
এছাড়া তারকাবৃতির গর্ভমুণ্ড এ ফুলকে দিয়েছে বাড়তি সৌন্দর্যময়তা। সাধারণত চালতার বৃতিগুলো দ্রুতই ফলে পরিণত হয় বলে এ ফুল দু-এক দিনের বেশি স্থায়ী হয় না। এটি প্রভাতে পাপড়ি মেলে আর সন্ধ্যায় ঝরে পড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রঙেও পরিবর্তন আসে ফুলটিতে। এরপর নিষিক্ত ফুলই পরবর্তীতে পরিপূর্ণ চালতা ফলে পরিণত হয়।
স্থানীয় বৃক্ষ গবেষক অধ্যাপক ইয়াসিন আলী বলেন, চালতা ফল বহুবিধ ঔষধিগুণ সম্পন্ন হলেও এর আচার দেশের নারী-শিশুদের জন্য খুবই লোভনীয় ও মুখরোচক খাবার হিসাবে ব্যাপক সমাদৃত। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগের অভাবে দিনে দিনে আবহমান গ্রাম বাংলা থেকে এ গাছটি হারিয়ে যাচ্ছে। অতীতে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিস্ময়কর ও বহুবিধ ঔষধিগুণসম্পন্ন এই চালতা গাছ দেখা গেলেও বর্তমানে এটি ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
হোসেনপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রি (অনার্স) কলেজের সহকারী অধ্যাপক নাজমুন নাহার বলেন, বহুবিধ ভেষজ ঔষধি গুণসম্পন্ন এ ফল পাকে বর্ষার পর। পাওয়া যায় শীতকাল পর্যন্ত। আষাঢ়-শ্রাবণে ফোটে চালতা ফুল। সুগন্ধি এ ফুলে পাঁচটি পাপড়ি থাকে। পাপড়িগুলো আঁকড়ে থেকে ফলে রূপান্তরিত হয়। ফোটার পর এ ফুলে মৌমাছির আগমন ঘটে। মৌমাছিরা মধু আহরণ করতে গিয়ে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে বসে। এভাবেই চালতার পরাগায়ন ঘটে। একটি চালতা ফলের গাছে বছরে একবারই ফল ধরে। প্রতিটি চালতা ফল স্বাভাবিকভাবে ২০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজন হয়ে থাকে।
স্থানীয় পরিবেশবিদ ও সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, এক সময় আমাদের গ্রামীণ জনপদের রাস্তার পাশে, পুকুরের ধারে ও বাড়ির আঙ্গিনায় অনেক চালতা গাছ দেখা যেতো। নানা কারণে এখন আর সে দৃশ্য খুব বেশি চোখে পড়ে না। তাই প্রকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এই বৃক্ষ লাগানো প্রয়োজন। তা না হলে আগমী প্রজন্ম এ ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য ও মুগ্ধতা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই এ বর্ষায় চালতা গাছ লাগানো খুবই জরুরি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ একেএম শাহজাহান কবীর বলেন, একটি চালতা গাছে বছরে একবারই ফল ধরে। চালতার ফুল সাধারণত রাতে ফোটে এবং ফুল ফোটার এক দিনের মধ্যেই ফুলের পাপড়ি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তাই পরিপূর্ণ একটি ফুল ফুটেই ঝড়ে যায়। যেহেতু এ গাছ ওষুধি গুণাগুণসম্পন্ন ও ফুলটি দেখতেও অত্যন্ত সুন্দর এবং সুগন্ধিযুক্ত,তাই পরিবেশবান্ধব এ গাছটিকে প্রকৃতিতে টিকিয়ে রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব।