জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে ভোলার চরাঞ্চলের শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। প্রান্তিক এসব এলাকার শিশুরা নানা ধরনের রোগ, মহামারী, পুষ্টিহীনতা, দুর্ঘটনা, এবং পরিবেশগত সংকটের শিকার হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মারাত্মক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, এবং পড়াশোনায়ও ব্যাপক বিঘ্ন ঘটছে।
সরেজমিনে ভোলা সদরের মেঘনা তীরবর্তী মাঝের চরে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, গৃহিণী রাবেয়া বেগমের ৪ বছর বয়সী ছেলে জামাল জন্মের পর থেকে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। তিনি জানান, “জামাল সবসময় জ্বরে ভোগে, সর্দি-কাশি, আমাশয় প্রায় হয়েই থাকে, গরমে শরীরে ফোঁসকা উঠে। ডাক্তার দেখালেও রোগের সঠিক পরিচয় মিলছে না, এবং তাকে নিয়ে দিন কাটানো খুব কঠিন।”
অন্য এক গৃহিণী, আরজু বেগম বলেন, “আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়েটির হাত সবসময় ফেটে রক্ত ঝড়ে। বহু ওষুধ খাইয়েও কোনো উপকার হচ্ছেনা।”
মাঝের চরের ১৫ বছর বয়সী কিশোরী নার্গিস বলেন, “আমার বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর বয়সে, এখন সতেরো। ৮ মাসের সন্তান রহিমের কাশি আর জ্বর খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। হাসপাতালে নিতে হলে একদিকে নদী পাড়ি দিতে হয়, অন্যদিকে সংসারের খরচ চলে না।”
এদিকে, স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক কালিমুল্লাহ জানান, “এ ধরনের চরাঞ্চলে মা ও শিশুরা একসঙ্গে স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। বহু পরিবারে শিশুর কোলে শিশু থাকার দৃশ্য অনেকটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে। অনেক শিশুই অজানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে তারা জীবনযুদ্ধে হেরে যাচ্ছে।”
ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর চরের এক মৎস্যজীবী, আব্দুল্লাহ মাঝি বলেন, “আমার দুই বছর বয়সী শিশুটি এখনও সঠিকভাবে হাঁটতে পারেনা। শরীরের নিচের অংশ বিবর্ণ এবং উপরের অংশ ফ্যাকাশে। রোগের সঠিক পরিচয় না পাওয়ায় ডাক্তারও কিছু করতে পারছেন না।”
ভোলার স্বাস্থ্য সহকারী মো: আলাউদ্দিন জানান, “বর্ষা মৌসুমে এই অঞ্চলের শিশুরা পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তবে বর্তমানে স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের চিকিৎসা সেবায় আরো বেশি মনোযোগী হয়েছে।”
ভোলা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ছোট থেকে বড় বয়সী অনেক শিশু নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের পরিবেশ এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা আগের তুলনায় উন্নত হলেও, চরাঞ্চলের শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা এখনও গভীর উদ্বেগের বিষয়।
ভোলার সিভিল সার্জন ডা. মো: মনিরুল ইসলাম বলেন, “ভোলা জেলা উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব শিশুদের শারীরিক অবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তবে আধুনিক চিকিৎসা সেবার উন্নতির কারণে এখন আগের মতো প্রতিবন্ধকতা আর নেই। চিকিৎসা সেবা আরো উন্নত করা হলে এসব শিশুদের চিকিৎসা সম্ভব হবে এবং তাদের জীবনযাত্রা উন্নত হতে পারে।”
উল্লেখ্য, চরাঞ্চলের শিশুরা শুধু শারীরিক সমস্যায় ভুগছে না, বরং সামাজিক সমস্যাও তাদের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। জীবন-জীবিকার সংকটে অনেক পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
মো: তুহিন হোসেন
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, চন্দ্রদ্বীপ নিউজ ২৪ ডট কম