মো: আল-আমিন (পটুয়াখালী): বাপ-দাদার পেশা কৃষিকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন ছিল নুরুল ইসলামের (৪০)। কিন্তু উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে আবাদি জমিতে বছরের পর বছর ধরে ফলন কমে আসায় যে লোকসানের চক্রে পড়ে যান এক সময়ের স্বচ্ছল কৃষক নুরুল ইসলাম, তা থেকে আর বের হতে পারেননি তিনি। এক পর্যায়ে দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে ভিটেমাটি রেখে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয় এই কৃষক পরিবারটি।
নুরুল ইসলামের ভিটে ছিল পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার পশ্চিম সোনাতলা গ্রামে। সেখানে নিজের আড়াই একর জমিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করতেন তিনি। এখন তিনি স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রামে থাকেন। স্যানিটারি মিস্ত্রির কাজ করেন।
নুরুল ইসলামের মতো পাশের আদমপুর গ্রামের খলিলুর রহমানও চার বছর আগে কৃষিকাজ ছেড়েছেন।
খলিলুরের ভাষ্য, তার খেতে যে ধান হতো, তার অর্ধেকটাই চিটা হয়ে যেত। অধিক তাপমাত্রার কারণে ধান পরিপক্ব হতো না। এখন তিনি কৃষিকাজ বাদ দিয়ে কলাপাড়া উপজেলা শহরে স্যানিটারি মিস্ত্রির কাজসহ দিনমজুরি করে সংসার চালান।
একই এলাকার আরেক কৃষক সেলিম খান বলেন, ‘আগের তুলনায় তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছেই। এ কারণে বেশির ভাগ ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। চিটা ধান থেকে পাওয়া চাল ভালো দামে বিক্রি করা যায় না। আবার এ চালের ভাতে স্বাদ কম। তিতা লাগে। বাধ্য হয়ে তা হাঁস-মুরগিকে খাওয়াতে হয়।’
সেলিম আরও বলেন, ‘বেশি তাপমাত্রার কারণে এখন উৎপাদিত ধানের এক-তৃতীয়াংশ চিটা হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আগের তুলনায় এখন ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের এ অঞ্চলের কৃষিকাজ এখনো বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এখন আর সময়মতো বৃষ্টি হয় না। তাই ধানসহ অন্যান্য ফসলের স্বাভাবিক চাষাবাদ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’
কৃষক নুরুল ইসলাম, খলিল ও সেলিম খানদের এমন সব ভাষ্যের সত্যতা মিলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে। পটুয়াখালী জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবা জানান, গত ছয় বছরে পটুয়াখালী জেলার গড় তাপমাত্রা বেড়েছে অন্তত সাড়ে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৭ সালে এখানে গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এখানকার গড় তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পটুয়াখালীর মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সহিদুল ইসলাম খানও তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার বিষয়ে সহমত পোষণ করেন।
সহিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকার আবাদযোগ্য কৃষি জমিতে আগের তুলনায় লবণাক্ততা অনেকটাই বেড়েছে। ফলে কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত ফসল পাচ্ছেন না।’
এসব কারণে এ অঞ্চলে কৃষিকে এখন আর লাভজনক পেশা বলা যাচ্ছে না। অনেকেই পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানেও মিলেছে এর সত্যতা। গত বছর পটুয়াখালী জেলায় কৃষক পরিবারের সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৬৬ হাজার ৬৩০। ১০ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল তিন লাখ ছয় হাজার। অর্থাৎ এ সময়ে কৃষক পরিবারের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৪০ হাজার বা ১৫ শতাংশ।