শিরোনাম

ঝালকাঠিতে ডিজিটাল ব্যানারের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে রংতুলির জাদুকররা

Views: 112

এস এল টি তুহিন,বরিশাল :: রং আর তুলির ছোঁয়ায় নতুন এক ভাষার জন্ম দেন শিল্পীরা। রংতুলির খেলার মাঝে খুঁজে নেন নিজের আনন্দ। নিজ এবং পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বটাও তুলে দেন এই রংতুলির হাতেই। এভাবেই জীবন চলে চারু শিল্পীদের।

তবে শিল্পে প্রযুক্তির ছোঁয়া পাল্টে দিচ্ছে এসব শিল্পীদের জীবনযাত্রা। আগে জাতীয় বা স্থানীয় নিবার্চনে ব্যানার ফেস্টুন, সিনেমার পোস্টার তৈরি নিয়ে যারা অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করতেন আজ তারাই কাজের অভাবে নিজ পেশা ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ঝালকাঠি জেলায় এক সময় রংতুলির আঁচড়ে ব্যানার বা সাইনবোর্ড লিখে জীবিকা নির্বাহ করতেন প্রায় অর্ধশতাধিকের বেশি শৌখিন বা পেশাজীবী শিল্পীরা। আধুনিক যুগে ডিজিটাল নির্ভর কর্মক্ষেত্রে সাইনবোর্ড বা ব্যানার লিখন কাজের ব্যাপক চাহিদায় কদর কমেছে মূলধারার চারু শিল্পীদের।

ঝালকাঠি জেলায় বর্তমানে কয়েকজন নামে মাত্র টিকে আছেন। শহরে চলতে গেলে আগে বাসের গায়ে, ট্রাকের গায়ে, রিক্সার গায়ে, ট্রাক, বিলবোর্ড কিংবা দেয়ালের গায়ে শিল্পীর হাতে আঁকা মনের মাধুরি মেশানো হরেক রকম ছবি চোখে পড়ত। সিনেমা হলগুলোর সামনে সিনেমার দৃশ্য আঁকা হতো শিল্পীর রং তুলিতে। বিভিন্ন সভা সমাবেশে কাপড়ের ওপর হাতের লেখা সেই নিপুণ ব্যানার এখন অতীত হয়ে গেছে। এক সময় যাদের রংতুলির আঁচড়ে নানা ধরনের ব্যানারের লেখা শোভা পেত শহরের সড়কের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড থেকে শুরু দেয়ালিকায় শোভা পেত রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা তারা আজ হারিয়ে যেতে বসেছেন। এসব স্থানে তাকালে এখন আর দেখা মেলে না এসব শিল্পের। যান্ত্রিকতার এই যুগে হারিয়ে যাচ্ছে রং আর তুলির কারুকাজ ও শিল্পীরা। এখন অল্প টাকায় স্বল্প সময়ে প্যানাপ্লেক্সের (ফেস্টুন) তৈরি বিভিন্ন ধরনে ব্যানার পাওয়া যাচ্ছে। আবার ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা ঝুঁকছেন ডিজিটাল ব্যানারে দিকে।

চারুশিল্পের উপর গুরুত্ব দিয়ে সরকার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত চারুকারু শিক্ষার জন্য জুড়ে দিয়েছে বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যবই। তবে শিক্ষার্থীরা এ শিক্ষা অর্জন করে ভবিৎষতে কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের স্থানের অভাবে এ বিষয়ে আগ্রহ হারাচ্ছেন। কমে যাচ্ছে রং-তুলি দিয়ে করা চারু শিল্পের কাজের ব্যাপকতা।

শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রামেও ডিজিটাল ব্যানার প্রসার লাভ করেছে। তাই জীবিকা নির্বাহের প্রতিযোগিতায় রং-তুলি ছেড়ে শিল্পীরা ঝুঁকে পড়ছেন অন্য পেশায়। তারপরও যারা এ পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন তারাও ভালো অবস্থানে নেই। দেয়ালে কাপড় টানিয়ে ব্যানার লিখন, লঞ্চ স্টিমারে ও প্রতিষ্ঠানে দেয়াল লিখন কাজের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে ডিজিটাল ব্যানার।

ঝালকাঠির রাজাপুর সদরের বিশ্বাস বাড়ি এলাকার অঞ্জন মিস্ত্রী। উচ্চ শিক্ষিত হাসিখুশি একজন মানুষ। পরিবারের ছয়জনের মধ্যে তিনি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ছোটবেলা থেকেই তার শিল্পী মন নিয়ে বেড়ে ওঠা। মঞ্চ অভিনয় আর আর্টের ওপরে ছিল তার খুবই দুর্বলতা। তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নিয়েছেন প্রশিক্ষণ। এক সময় সংসারের ভার তার কাঁধে পরতেই শখের বসে করা শিল্পটাকেই নিয়ে নিলেন পেশা হিসেবে। এরপর তিনি রাজাপুর উপজেলার ডাকবাংলো মোড়ের ভাড়ার দোকানে দীর্ঘ ২৭ বছরের বেশি সময় ধরে এই শিল্পকে সঙ্গী করে চলেছেন। একটা সময় তিনি নিজ উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকেও ব্যানার, সাইনবোর্ড, ফেস্টুন লেখা, ছবি আঁকা, বাঁধাই, ওয়ালমেট বাঁধাইসহ বিভিন্ন কাজ করেছেন তার রং-তুলি ছোঁয়ায়। তার ছোট টিনের ঘরটিতে সর্বদা মানুষের ভিড় লেগে থাকত। তিনি হাসিমুখে রং-তুলির মিলনে কাপড়, কাঠ, টিনের বুকে, দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তুলতেন গ্রাহকের মনের ভাষা।

কিন্তু এখন অঞ্জন মিস্ত্রীর মুখেও নেই আর আগের মতো হাসি। দোকানেও নেই আগের মতো গ্রাহকের ভিড়। এখন তার দোকানের সামনে গেলে দেখা যায় অঞ্জন মিস্ত্রী মন মরা হয়ে দোকানে বসে আছে। এ যেন বয়স থাকতেও অবসরে যেতে বাধ্য করার মতো। গায়ে নেই আগের মত বাহারি পোশাক। হাতে নেই তার কাজ, তবুও মাথার উপরে রয়েছে সংসারের চাপ।

কথা হয় রাজাপুর উপজেলার শিল্পী অঞ্জন মিস্ত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি যেমন আছে আর আমরা যাদের অনুপ্রেরণায় এই শিল্পের হাল ধরেছি সেটা যদি তারা জানতেন তাহলে হয়তো তারাও এই শিল্পের প্রসার ঘটাতেন না। এই শিল্প বর্তমানে ডিজিটাল হয়ে গছে। আর শিল্পীরা কোন রক্ত মাংসের মানুষ নয়। তারা উন্নত দেশের লোহার তৈরি যন্ত্র। তাদের কাছে মানুষ যেমন করে চায় সে তেমন করেই মানুষের প্রয়োজন মেটায়। আমাদের সকল কাজ এখন ওই যন্ত্রের দখলে। তাই এখন আমাদের জীবন কাঁটছে অর্ধাহারে, অনাহারে। আমি শিল্পী মানুষ তাই শুধু এই কাজটাই শিখেছি। এটাই পারি এছাড়া আর কিছু পারি না। বয়সের কালে লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটিনি। এই শিল্পের পিছনে ছুটছি। এখন আর এই বয়সে চাকরি করার সুযোগ নেই। আমার মতো দেশে সব শিল্পীদের বর্তমানে একই অবস্থা।

কথা হয় ঝালকাঠি শহরের শিল্পী জয়দেব মালাকর জয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি একজন চিত্রশিল্পী। কাজ করি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে-মাদরাসায় বিভিন্ন রকমের ছবি আঁকা ও লেখার কাজ করে দিনযাপন করতাম। তবে ডিজিটাল প্লাস্টিকের তৈরি ব্যানার আসার কারণে এখন আর কেউ আমাদের কাছ থেকে কাজ করায় না। যার ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটছে। এতগুলো বছর এই পেশায় নিয়োজিত থেকে শেষ বয়সে এসে অন্য কোনো পেশায় যেতে পারছি না অর্থভাবে। তাই সকলের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ। আপনারা ডিজিটাল প্লাস্টিকের ব্যানার বর্জন করুন। এতে পরিবেশ দূষণ হয়, স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায়।

কথা হয় কাঁঠালিয়া উপজেলার বৈশাখী আর্টের গান্ধী হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৯৫ সাল থেকে এই শিল্পে নিয়োজিত।এক সময় নির্বাচন, সরকারি অফিস-আদালতের সাইনবোর্ড ব্যানার আমিই লিখতাম। প্রতিনিয়ত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা কাজ করতাম। আগে বিভিন্ন দিবসসহ নানান সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে কাজের অর্ডারে গভীর রাত পর্যন্তও কাজ করতে হতো। এখন সর্বত্র ডিজিটাল ব্যানারের প্রভাবে সাইনবোর্ড, ব্যানার লিখনের কাজ তেমন একটা আসে না বললেই চলে। তবে এখনো পথেঘাটে দেয়াল, লঞ্চ-স্টিমারসহ বিদ্যালয়ের দেয়াল লিখনের কাজের কিছুটা চাহিদা থাকায় এই পেশাটা আকড়ে বেঁচে আছে।

শিল্পি ইউনুচ আলী হাওলাদার বলেন, আমি নলছিটিতে অনেক আগ থেকেই আর্ট পেশার সাথে জরিত মূলত বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ড ও ব্যানার লিখতাম। তবে এখন কাজের সংখ্যা খুবই কম এখন সবাই তিন থেকে চারশ টাকার মধ্যে একটা প্যানাপ্লেক্সের ব্যানার লিখে এনে সহজেই দোকানের সামনে সাটিয়ে দিচ্ছেন। ঠিক একই কাজ আমাদের দিয়ে করাতে রং ও মজুরিসহ কম করে হলেও একহাজার টাকা দিতে হবে। তাই অনেকেই খরচ ও সময় বাঁচানোর জন্য আমাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন না। যদিও আমাদের রং দিয়ে তৈরি কাজের স্থায়িত্ব অনেক বেশি ও পরিবেশবান্ধব। আর প্যানাপ্লেক্সের তৈরি সাইনবোর্ড ও ব্যানারে যে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং এর স্থায়িত্বও তুলনামূলক কম। সবমিলিয়ে আমাদের আর্ট শিল্পিদের খারাপ সময় যাচ্ছে। তাই এই পেশার সাথে জরিত মানুষের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।

কাঁঠালিয়া সদর ফাজিল মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক নুর-ই-আলাম ছিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে আধুনিক যুগে ডিজিটাল নির্ভর কর্মক্ষেত্রে ডিজিটাল সাইনবোর্ড বা ব্যানার লিখন কাজের ব্যাপক চাহিদায় মূল ধারার চারু শিল্পীদের কদর কমেছে।

নলছিটি উপজেলার মোবাইল ব্যবসায়ী নয়ন হোসেন বলেন, আমি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল সাইনবোর্ড ব্যবহার করি। তাতে আমার খরচ বেশি পরে এবং বিদ্যুৎ বিলও গুণতে হয়। তবে এটা রং তুলি দিয়ে তৈরি কাজের চেয়ে অনেক চকচকে তাই সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই এটা ব্যবহারকেই ব্যবসায়ীরা এখন বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।

প্রভাষক আমির হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীরা এ শিক্ষা অর্জন করে ভবিৎষতে কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের স্থান না দেখে চারু শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এজন্য ক্রমেই বিলুপ্তি হয়ে পড়ছে দেশের গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে চারু শিল্পীদের কারুকাজ।

সাংস্কৃতিক কমী মাইনুল ইসলাম সুজন বলেন, রং-তুলির শিল্পীরা বাঙালি ঐহিত্যের ধারক ও বাহক। বর্তমানে তারা এই পেশায় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। তারা শুধু ব্যানার-ফেস্টুন তৈরি না বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালির কৃষ্টি কালচারকেও রং-তুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন। প্যানাপ্লেক্স দিয়ে যেসব জিনিস তৈরি করা হচ্ছে সেগুলো পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকরও বটে। তাই সরকারের উচিত এসব শিল্পীদের টিকিয়ে রাখতে প্যানাপ্লেক্সের তৈরি ব্যানার ফেস্টুনের ব্যবহার সীমিত করা বা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেওয়া।

ঝালকাঠির সামাজিক সংগঠন ইয়ুথ অ্যাকশন সোসাইটির (ইয়াস) সাংগঠনিক সম্পাদক সাব্বির হোসেন রানা বলেন, একটা সময় বিভিন্ন সভা সমাবেশে চারু শিল্পীদের হাতে লেখা ব্যানার ব্যবহার করতেন মানুষ। এখন আর তাদের দিয়ে কেউ লেখালেখির কাজ করাতে চান না। তাই তাদের এখন দুর্দিন যাচ্ছে। তাদের নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *