চন্দ্রদ্বীপ ডেস্ক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার হতে যাচ্ছে। এই বিচার কার্যক্রম সামনে রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রসিকিউশন সংস্থা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া সাবেক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মাজহারুল হককে কো-অর্ডিনেটর করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ১০ সদস্যের তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও প্রসিকিউশন সংস্থায় গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত হত্যা-গণহত্যার ২৮টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এগুলোতে আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদের প্রভাবশালী সদস্যদের। এ ছাড়া গণহত্যার নির্দেশদাতা ও গণহত্যায় অংশ নেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা এবং গণহত্যায় উসকানিদাতা সাংবাদিকদেরও নাম আছে এ তালিকায়। চলতি সপ্তাহেই বিচারক নিয়োগ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে বলে জানা গেছে। এরপর শুরু হবে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রেক্ষাপট
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার পর গত ১৪ বছরে ট্রাইব্যুনাল ৫৫টি মামলার রায় দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে বেশ কয়েকজনের দণ্ডও কার্যকর হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এরপর দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর ১৪ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান, গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে।
যে আইনে হবে বিচার
১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনেই শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্তদের তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মূলত ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্যই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের নেতাদের বিচার করা হয়েছে।
১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের ৩ (১) ধারায় বলা আছে, আইনের ২নং উপ-ধারায় উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সংস্থা বা কোনো সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর কোনো সদস্যের জাতীয়তা যাই হোক না কেন, তা যদি এই আইন প্রবর্তনের আগে বা পরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়, তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার এবং শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে।
অর্থাৎ মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশনবিরোধী কাজসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যেকোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা দল, সেনাবাহিনী কিংবা তাদের সহযোগী সশস্ত্র বাহিনীর বিচারের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হয়েছে।
যে প্রক্রিয়ায় এগোবে বিচার
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম। সার্বিক বিষয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করার দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হলো সরাসরি তদন্ত সংস্থায় কোনো অভিযোগ দায়ের করা। এটা কোনো আইনজীবীও করতে পারেন অথবা কোনো জ্ঞাত ব্যক্তি, যিনি ঘটনা সম্পর্কে জানেন। আর আমরা প্রসিকিউটর নিয়োগ হওয়ার পরে আরেকটি পথ ওপেন করেছি, সেটি হচ্ছে প্রসিকিউশন সংস্থায় কেউ চাইলে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তদন্ত সংস্থায় বা প্রসিকিউশনে দাখিল করা অভিযোগগুলো তদন্ত সংস্থার অধীনে প্রসিকিউশনের তত্ত্বাবধানে তদন্ত হবে। এই তদন্ত কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর তদন্ত সংস্থা একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে চিফ প্রসিকিউটর বরাবর। চিফ প্রসিকিউটর এই তদন্ত প্রতিবেদনকে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ, যেটাকে আমরা আইনের ভাষায় বলি ফরমাল চার্জ। ফরমাল চার্জ আকারে চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনাল বরাবর দাখিল করবেন। তখন ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা ফরমাল চার্জ শুনানির দিন ধার্য করবেন। ট্রাইব্যুনাল যদি ফরমাল চার্জের ভেতরে যে তথ্য-উপাত্ত দেওয়া আছে, সাক্ষীদের নাম দেওয়া আছে তা সঠিক বলে মনে করেন তাহলে ট্রাইব্যুনাল ওই অভিযোগ আমলে নেবেন। অর্থাৎ আসামিদের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তা আমলে নেবেন। আমলে নিয়ে একটি অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য করবেন, যেটাকে আমরা বলি চার্জ হেয়ারিং।
‘ট্রাইব্যুনালে চার্জ হেয়ারিং হবে। সেখানে বাদীপক্ষ, আসামিপক্ষ শুনানি করবেন। বাদীপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের আবেদন জানাবেন। আসামিপক্ষ চার্জ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আবেদন জানাবেন। দুই পক্ষের শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল যদি অভিযোগের সত্যতা প্রাথমিকভাবে পেয়ে থাকেন তখন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করবেন। অথবা যদি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হয় তাহলে আসামিদের অব্যাহতি দিতে পারেন। যদি অব্যাহতি দেন তাহলে ওখানেই মামলা শেষ। আর যদি অভিযোগ গঠন করেন তখন ট্রাইব্যুনাল সাক্ষীদের ডাকবেন সাক্ষ্য দিতে। তারপর ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান হবে। আসামিপক্ষ সাক্ষীদের জেরা করবেন। আসামিপক্ষও সাক্ষ্য প্রদানের সুযোগ পাবেন। আসামিপক্ষ তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষী দেওয়ার সুযোগ পাবেন। সাফাই সাক্ষ্য শেষে ট্রাইব্যুনাল যুক্তিতর্কের দিন ধার্য করবেন। উভয়পক্ষ সেখানে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। যুক্তিতর্ক শেষে ট্রাইব্যুনাল একটি রায়ের দিন ধার্য করবেন।