শিরোনাম

নিষ্ফল ‘পুনর্বাসন’, ভিক্ষুকে অতিষ্ঠ বরিশালবাসী

Views: 134

বরিশাল অফিস:: বরিশাল নগরের দক্ষিণ আলেকান্দা এলাকায় রবিউল ইসলামের চা-পান বিক্রির ছোট একটি দোকান রয়েছে। এ থেকে তার দৈনিক পাঁচশ টাকা আয় করতে হিমশিম খেতে হয়। আর সেই আয়ের মধ্য থেকেই তিনি অসহায়দের সাহায্যের জন্য কিছু অর্থ আলাদাও করে রাখেন।

এক কথায় ওই অর্থ ভিক্ষুকদের জন্যই বরাদ্দ থাকে। শুধু যে রবিউল ইসলামের দোকানেই এমন বরাদ্দ, তা নয়। নগরের প্রায় সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই নির্দিষ্ট অর্থ রাখে ভিক্ষুক কিংবা অসহায়দের সাহায্যে। তবে রবিউল ইসলামসহ অনেকে এখন ভিক্ষুক নামের অসহায়দের অর্থ দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন।

রবিউল ইসলামের ভাষ্য, কয়েক বছর আগেও এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট কিছু ভিক্ষুক সপ্তাহে মাত্র দুই-একদিন আসতেন ভিক্ষা করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন দোকানে আসছেন ভিক্ষুক। সেই সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না।

রবিউল বলেন, যদি ১০ জন করে আসেন,‌ আর দুই টাকা করে দিই, তাহলে প্রতিদিন ২০ টাকা আর সপ্তাহে ১৪০ টাকা, মাসে ৬০০ টাকা। এ তো আমার একদিনের আয়ের চেয়েও বেশি। তাই এখন বাধ্য হয়ে বেশিরভাগ ভিক্ষুককে একটি শব্দই বলতে হয়। সেটি হলো ‘মাফ করেন’।

নগরের ভাটারখাল এলাকার ব্যবসায়ী জসিম বলেন, প্রতিদিন দোকানে এত ভিক্ষুক আসেন যে, সবাইকে আর সহযোগিতা করতে পারি না। কয়েক মিনিট পর পর ভিক্ষুক আসায় সকালে আর সন্ধ্যায় তো ক্রেতা দোকানেই আসতে চান না। আগে এমনটা ছিল না।

শুধু যে ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এমন হচ্ছে তা নয়, ভিক্ষুকের কারণে অতিষ্ঠ গোটা নগরের বাসিন্দারা। বাজার এলাকা থেকে শুরু করে আধুনিক শপিং মল, বিনোদনকেন্দ্র, বাস টার্মিনাল থেকে নদীবন্দর, মহল্লার গলি থেকে প্রধান সড়ক, সবখানেই এখন ভিক্ষুকের মেলা। এর মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি।

তবে প্রশাসন বলছে, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলমান। আর আগের সময়ের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ঈদকে সামনে রেখে রমজানের এ মাসে ভিক্ষুকের সংখ্যা কিছুটা বাড়তি থাকে নগরে। যারা মৌসুমি ভিক্ষুক।

নগরের প্রাণকেন্দ্র সদর রোডে যারা নিয়মিত চলাচল করেন, তারা বলছেন এলাকায় ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েছে। আবার নগরের নথুল্লাবাদ, রুপাতলী বাস টার্মিনাল ও লঞ্চঘাট এলাকায় যাদের নিয়মিত চলাচল, তারাও বলছেন, রমজানের আগে থেকেই ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েছে।

নগরের বিবির পুকুর পাড়ে নিয়মিত আড্ডা দেন মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, বিবির পুকুর পাড়ে আগে সন্ধ্যার পর ভিক্ষুকের আনাগোনা থাকলেও এখন রাত-দিন সবসময় অনেক ভিক্ষুক থাকে। আর কিছু খাওয়ার সময় নয়তো পকেট থেকে টাকা দেওয়ার সময় সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাত এগিয়ে দেন ভিক্ষুকরা। মাঝে মধ্যে খুব বিরক্ত লাগলেও কিছু করার থাকে না। বলতে হয় ‘মাফ করেন’।

তার মতো সোহেল নামে আরেক তরুণ বলেন, ওই এলাকায় পুরুষের চেয়ে নারী ভিক্ষুকের সংখ্যাই বেশি। আর সবাই সুস্থ-সবলভাবে চলাফেরা করেন। তাদের কাউকে যদি কাজের জন্য বলা হয়, তাহলে ক্ষেপে যান। আবার পাঁচ টাকার কম দিলেই মুখ গোমড়া করে হেঁটে যান। কী যে বিপদে থাকতে হয়!

নগরের বাজার রোড এলাকার বাসিন্দা কামরুল বলেন, আগে ভিক্ষুক দেখলে সাহায্য করতে মন চাইতো। আর এখন তো সুস্থ-সবলরাও ভিক্ষার নামে সাহায্যের হাত পাতেন। তবে মজার বিষয় হলো রমজানে বেশিরভাগ নারী ভিক্ষুক বোরকা পরে, নয়তো কোনোভাবে মুখ ঢেকে নেন, আর পুরুষরা মাথায় টুপি দিয়ে মুখে মাস্ক পড়ে নেন। আর তাদের কাজের কথা বললেই রেগে যান, গালি দেন কিংবা অভিশাপ দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল নগরের চাঁদমারি, কেডিসি, ভাটারখাল, রসুলপুর, কলাপট্টিসহ বেশ কিছু বস্তি এলাকায় ভিক্ষুকদের বসবাস। মৌসুমি ভিক্ষুকরা ওই এলাকাগুলোতে দুই-তিন মাসের জন্য বাসা ভাড়া করে থাকেন। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ভিক্ষা করে ফিরে আসেন ভাড়া বাসায়।

সামাজিক কারণে নিজের পরিচয় গোপন রেখে একজন ভিক্ষুক জানান, নগরের কোনো ভিক্ষুক দিনে তিনশ টাকার নিচে আয় করেন না। তবে অবস্থা ও এলাকা বুঝে দিনে অনেকের আয় পাঁচশ টাকা বা তার বেশি গিয়েও ঠেকে। নির্দিষ্ট এলাকার অল্প হাঁটাহাঁটি করে ভালো টাকা আয় হওয়ায় এ ভিক্ষুকদের কেউ দিনমজুরের মতো পরিশ্রমের কাজ করতে চান না।

এক নারী ভিক্ষুক জানান, ভারী কাজ করতে পারেন না তিনি। অভাব-অনটনের কারণে ভিক্ষায় আসা। তবে সম্প্রতি তিনিও তার এলাকায় অনেক নতুন ভিক্ষুক দেখছেন, যাদের কেউ সন্তান, স্বামী, বাবা-মায়ের অসুস্থতার কথা বলে ভিক্ষা চাচ্ছেন। প্রতি বছর রমজানে নতুনদের দেখা মেলে। এ নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না, কারণ কিছু বললেই ঝগড়া বেঁধে যাবে।

২০১৯ সালে বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান জানিয়েছিলেন, বরিশাল জেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভিক্ষুক রয়েছে। ওই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে তিনি জানান, তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি উপজেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত করার সময় বেঁধে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই থেকে এ পর্যন্ত পুনর্বাসন কার্যক্রম চলছে। তবে ভিক্ষুকের সংখ্যা কমা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজ জানান, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে প্রতিবছর বরাদ্দ আসছে। বিভাগের ১০টি উপজেলায় তা ভাগ করে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে পুনর্বাসনের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি বুধবার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে যদি কেউ হাজির হয়ে অসহায়ত্বের কথা জানান, তবে জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম তাকে সাহায্যের চেষ্টা করেন।

তার মতে পুনর্বাসনের মাধ্যমে প্রকৃত ভিক্ষুকের সংখ্যা কমছে, তবে রমজানে শহরকেন্দ্রিক ভিক্ষুকের সংখ্যা কিছু বাড়ে, যাদের বেশিরভাগকেই ‘মৌসুমি ভিক্ষুক’ বলা যায়।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *