বরিশাল অফিস :: আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় দেশে কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন কৃষিবিদরা। তৈরি করেছেন ট্রাক্টরসহ বিভিন্ন বীজ বপন যন্ত্র। ঠিক তখনই কোনো ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই বহুমুখী সবজি চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের গগন গ্রামের কৃষকরা। খাল-বিলের কচুরিপানা কাজে লাগিয়ে তৈরি করছেন ভাসমান সবজির ক্ষেত। আর এই ভাসমান সবজির বেড বা ক্ষেত হয় মূলত বর্ষা মৌসুমেই।
আষাঢ়-শ্রাবণে বৃষ্টির পানি ভরা খাল-বিল পেয়েই ব্যবস্থা বেড়ে যায় কৃষকদের। ভাসমান বেডে উৎপাদিত সবজি নিয়েই জমে ওঠে মিয়ারহাট-স্বরূপকাঠিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাসমান সবজির বাজার।
চাষি সোহেল আহমেদ জানান, ঘন, লম্বা ও পুরুস্তরের কচুরিপানার ওপর একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের বাঁশ ফেলে এ বেড তৈরি হয়। পরে দুপাশ থেকে কচুরিপানা টেনে এনে বাঁশের ওপর স্তরে স্তরে সাজাতে হয়। কচুরিপানার স্তর সাজানোর সময় কচুরিপানা পানিতে যেভাবে থাকে সেভাবে ঘন করে অর্থাৎ খাড়া করে সাজাতে হবে। পরে অর্ধেক স্তর সাজানোর সময় কচুরিপানা উল্টো করে সাজাতে হবে, অর্থাৎ এর শিকড় ওপরের দিকে থাকতে হবে। তারপর পা দিয়ে চেপে চেপে উঁচু স্তর তৈরি করতে হবে। এ পর্যায়ে কোনো ফাঁকা জায়গা থাকা যাবে না। এই স্তূপের ওপরে প্রয়োজনীয় কচুরিপানা তুলে মাপ অনুযায়ী ধাপ তৈরি করতে হবে। ধাপের ওপরের অংশে অপেক্ষাকৃত ছোট কচুরিপানা, খুদি পানা, টোপা পানা দেওয়া ভালো। বন্যা, ঢেউ বা জোয়ার-ভাটার স্রোত থাকলে বেডের মাঝামাঝি জায়গায় বাঁশের খুঁটি বা চারপাশে ফ্রেম দিতে হবে।
তিনি আরও জানান, ভাসমান বেড তৈরির পর উপরিভাগ আবাদ উপযোগী হতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগে। বেড তৈরির পর এতে সারি করে সরাসরি বীজ বোনা যায়। আবার বল বা বিড়ায় তৈরি করা চারা নির্দিষ্ট দূরত্বে বেডে রোপণ করা যায়। আদা, হলুদ, কচু প্রভূতি ফসল সরাসরি রোপণ করা যায়। চারা ৫-৬ ইঞ্চি হলে এবং শিকড়ের মাথা বল থেকে বের হলেই (কালো হওয়ার আগেই) বেডে লাগাতে হবে। বিড়া বা ব্যাগের চারা একত্রে বেডে নির্দিষ্ট পরিমাণ গর্ত করে রোপণ করতে হবে। বিড়ার আকার ছোট হলে পার্শ্বে পচা কচুরির আস্তরণ দিতে হবে। নতুন আস্তরণের সঙ্গে ১-২ চা চামচ জৈব সার প্রয়োগ করলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়বে। চারা লাগানোর পর সামান্য পানি দিয়ে চারা ও চারার গোড়া ভিজিয়ে দেওয়া আবশ্যক। চারা বেশি লম্বা হলে বাউনি দিতে হবে। অধিক ফলন পাওয়ার জন্য ভাসমান বেডে ঢ্যাঁড়স, টমেটো, বেগুন, কলমিশাক ইত্যাদি ফসলের সঙ্গে আন্তঃফসল ও মিশ্র ফসল হিসেবে ঝিঙে, লালশাক, পুঁইশাক, ধনিয়া, ডাটা প্রভৃতি চাষ করা যায়। তা ছাড়া এই অঞ্চলের পানি কচু দেশের বিভিন্ন জেলা ও প্রত্যন্ত গ্রামের বাজারগুলোতে পাওয়া যায়।
ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান জানান, এখানে উৎপাদিত সবজি অল্প দামে কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করি। নৌকা অথবা ট্রলারে পরিবহনের কারণে খরচ কম হয়। তাই মুনাফা বেশি থাকে।
একাধিক চাষি বলেন, এ ধরনের চাষ বেশ ব্যয়বহুল। তাই এ চাষে সরকারি প্রণোদনা পেলে ভালো হয়। এখন বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিওর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আমরা এই চাষাবাদ টিকিয়ে রাখছি। আমাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হলে এ প্রক্রিয়ায় সবজি চাষে আগ্রহ বাড়বে।
বলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান জানান, বেডে উৎপাদিত সবজি সম্পূর্ণ বিষমুক্ত। ভাসমান বেডে সবজি চাষে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার হয় না। ফলে সবজির গুণমান ও স্বাদ অক্ষুণ্ন থাকে। এ ব্যাপারে কৃষকদের মাঝে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পিরোজপুর নেছারাবাদ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চপল কৃষ্ণ নাথ জানান, ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদনকারী কৃষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের সবজির বীজ বিতরণ করা হচ্ছে। আগামী মৌসুমে এ প্রক্রিয়ায় চাষাবাদে কৃষকের আগ্রহ আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।