শিরোনাম

পটুয়াখালীতে ভরা মৌসুমেও ইলিশের আকাল – দুশ্চিন্তায় জেলেরা

Views: 35

পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: পটুয়াখালীর মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুরে ভরা মৌসুমেও ইলিশের দেখা নেই। সমুদ্রগামী জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না কাঙ্ক্ষিত এই মাছ। এ বছর ঘন ঘন বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে মৌসুমের অধিকাংশ সময়ই ঘাটে বসে কর্মহীন সময় কেটেছে জেলেদের।

আবহাওয়া অনুকূলে আসার পর পরই সমুদ্রে গিয়ে জাল ফেলেও ইলিশ মিলছে না। ফিরতে হচ্ছে অন্যান্য মাছ নিয়ে। তাতে সমুদ্র যাত্রার খরচও উঠাতে পারছেন না অধিকাংশ জেলে। অভাব- অনটন আর দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে তাদের। মাঝেমধ্যে কিছু ট্রলারে ইলিশের সরবারহ বাড়লেও দাম চড়া হওয়ায় মধ্যবিত্তদের তা আর ক্রয় ক্ষমতার নাগালে থাকছে না।

পটুয়াখালীর মৎস্য বন্দর ও উপকূলের বিভিন্ন আড়ত ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উপকূলীয় ও গভীর সমুদ্রের জেলেরা মাছ শিকারে যাওয়া-আসা করছেন। সমুদ্র থেকে আসা ট্রলারে যে পরিমাণ মাছ নিয়ে আসছেন, তা দিয়ে খরচ টাকা তুলতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকে আবার খরচের টাকাই তুলতে পারছেন না। কিছু জেলে মাঝেমধ্যে কাঙ্ক্ষিত মাছ পেলেও তা অতি নগণ্য।

দেশের সর্বদক্ষিণের উপকূল অঞ্চল হওয়ার সুবাধে অধিকাংশ বাসিন্দা জেলে পেশার সঙ্গে জড়িত। কলাপাড়া উপজেলায় ১৯ হাজার নিবন্ধিত জেলে। হিসাব অনুযায়ী, জেলায় মোট ৭৯ হাজার নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। এর বাইরেও মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন এখানকার লক্ষাধিক জেলে।

তবে গত কয়েক বছরের দিকে লক্ষ্য করলে জানা যায়, অভাব অনটন আর ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে অনেকেই জেলে পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন। কেউ আবার ইলিশের বিকল্প হিসেবে জীবিকার তাগিদে অন্যান্য মাছ ধরতে বৈধ-অবৈধভাবে উপকরণ এবং পদ্ধতি পরিবর্তন করেছেন।

স্থানীয় জেলেরা জানান, বৃষ্টিপাত হলে সমুদ্রে মাছ বাড়ে। কিন্তু সম্প্রতি টানা বৃষ্টিপাত হলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত মাছ। উপকূলের নদ-নদীতেও জেলেদের জালে মিলছে না ইলিশ। এ সময় জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ার কথা।

একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশের মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে তারা দিনরাত নিয়মিত জাল ফেলছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ইলিশ না পেয়ে তাদের অনেককেই খালি হাতে ঘাটে ফিরতে হচ্ছে।

জেলে আলমগীর হোসেন জানান, জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন, এখন ভাদ্র পেরিয়ে ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু সমুদ্রে হন্যে হয়ে ঘুরেও মাছের দেখা পাচ্ছেন না। যে মাছ পাচ্ছেন তা দিয়ে খরচের টাকাই উঠছে না।

হানিফ নামে আরেকজন জেলে বলেন, উপকূলের ডুবোচর ও নাব্য সংকটের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

উপকূলবর্তী খুটা জেলে মো. জালাল হাওলাদার জানান, ২০ বছর ধরে আমরা ইলিশ মাছ ধরে আসছি। কিন্তু এখন আর ইলিশ পাচ্ছি না। আমাদের এখন গভীর সমুদ্রে গিয়ে জাল ফেলতে হয়। তবে তা দিয়ে আমাদের পোষাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে আমরা অন্যান্য মাছ ধরার জন্য উপকরণ পরিবর্তন করেছি।’

তিনি বলেন, ‘ইলিশের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের এই জেলে পেশা ছাড়া আর বিকল্প নেই। মহাজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ঋণ এনেছি। সেই ঋণ শোধ করার আগে চাইলেও অন্য পেশায় যেতে পারছি না।’

স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী হালিম জানান, এখানকার স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি আকারভেদে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। ছোট ইলিশ ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি।

আলীপুর মৎস্য বন্দর ট্রলার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি ও মেসার্স মনি ফিশের ব্যবস্থাপক মো. জলিলুর রহমান বলেন, ‘প্রতি বছর দেখতে পাচ্ছি ইলিশের সরবরাহ কমে আসছে। আমাদের এতে তেমন ক্ষতি না হলেও জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

সমুদ্রে ইলিশ কম পাওয়ার কারণ জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘মা ইলিশের সুষ্ঠু প্রজনন সময়কালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা আমাদের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যায়। ফলে আমাদের দেশীয় জেলেরা মাছ পাচ্ছে না। এ বিষয়ে প্রশাসনের আরও কঠোর হতে হবে। না হলে একসময় ইলিশের উৎপাদন একদম কমে যাবে।’

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান লোকমান আলী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরে ডুবোচর জেগেছে। নদ-নদীর পানি কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রজননের সময় মিঠা পানিতে চলে আসে ইলিশ। কিন্তু ডুবোচরের পাশাপাশি বিভিন্ন পদার্থের কারণে দিন দিন নদীর পানিও দূষিত হচ্ছে। প্রজননের সময় মা ইলিশ উপকূলসহ নদ-নদীতে আসতে না পারায় দিন দিন ইলিশের সংখ্যা কমছে।’

কলাপাড়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে আশা করা হচ্ছিল জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে। কিন্তু অধিকাংশ জেলেকে ফিরতে হচ্ছে অন্যান্য মাছ নিয়ে। ইলিশের আকাল যেন কাটছেই না৷ আবার যে পরিমাণ ইলিশ ঘাটে আসছে তা বিক্রি হচ্ছে চড়া দরে। ইলিশের সরবরাহ কম থাকায় এই সমস্যা হচ্ছে।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *