শিরোনাম

বিএনপির রাজনীতি : বরিশাল বিভাগে অভ্যন্তরে দুরবস্থা, সমন্বয়ের অভাব

Views: 55

বরিশাল অফিস:: বিগত সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে সাংগঠনিক বিভাগ হিসেবে বরিশাল বিএনপির পারফরম্যান্স মোটাদাগে ‘জিরো’ এমন কথা বলছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারাই। এ ক্ষেত্রে বরগুনা জেলার নাম সবার ওপরে। যদিও দু-একটি জেলা চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেখানে মূল দল এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল স্পষ্ট।

অনেক জেলা-উপজেলাতেই সংগঠন দুর্বল করে কমিটি-বাণিজ্যের অভিযোগ অনেক নেতার বিরুদ্ধে। যোগ্য নেতাদের বাদ দিয়ে নিজ বলয়ের লোক ‘সেটআপে’ মনোযোগী ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এমন নানা কারণে যথেষ্ট সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি আঞ্চলিক রাজনীতির মাঠে গুরুত্বপূর্ণ বরিশাল বিএনপি। যদিও বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিলকিস জাহান শিরীন মনে করেন, গত আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল। দ্বন্দ্ব-বিভেদ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা দ্বন্দ্বে বিশ্বাসী নই। বড় দল হিসেবে আমাদের মধ্যে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে।’ কমিটি গঠন করতে না পারা প্রসঙ্গে শিরীন জানান, ‘আমাদের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই সম্ভব হয়নি।’

বরগুনা :

বরগুনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেন ও অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ আছে। কেন্দ্রীয় বিএনপি এসব অভিযোগের তদন্ত করে আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ায় ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল বরগুনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে। ২০২২ সালের ৮ জুন জেলা বিএনপির ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এতে আহ্বায়ক করা হয়েছিল মাহবুব আলম ফারুক মোল্লাকে এবং সদস্যসচিব করা হয় তারিকুজ্জামান টিটুকে। তারিকুজ্জামান ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি মারা যান।

এ ছাড়া বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত সরকারবিরোধী কর্মসূচিতে ছয়টি উপজেলার কোথাও নেতাদের তেমন ভূমিকা ছিল না বললেই চলে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত না থাকলেও গ্রুপিং রয়েছে। বরগুনা-২ আসনের তিনবারের নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনি, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম ফারুক মোল্লা ও নজরুল ইসলাম মোল্লা এই তিন গ্রুপে বিভক্ত জেলা বিএনপি।

এসব বিষয়ে জানতে জেলা আহ্বায়ক মাহবুব আলম ফারুক মোল্লাকে একাধিকবার ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

পিরোজপুর

সরকারবিরোধী আন্দোলন চলার সময় পিরোজপুর জেলায় বিএনপির বেশির ভাগ রাজনৈতিক কার্যালয় বন্ধ ছিল। এর মধ্যে কয়েকটিতে সরকারদলীয় কর্মীরা তালা মেরে দিলেও বাকিগুলোতে মামলা-হামলার কারণে দেখা যায়নি নেতা-কর্মীদের। জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে নাশকতার অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ফলে জেলায় টানা কর্মসূচিতেও মাঠে ছিলেন না অনেক নেতা-কর্মী। স্থানীয় কয়েকজন নেতা অভিযোগ করেছেন, কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই বেশির ভাগ উপজেলায় কমিটি করা হয়েছিল। তবে এসব কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কর্মীদের তেমন একটা সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া কমবেশি সব উপজেলায় নেতৃত্বের মধ্যে বিভেদ রয়েছে। কাউখালী, নাজিরপুর উপজেলায় এই গ্রুপিং কম থাকলেও জিয়ানগর, স্বরূপকাঠিতে দ্বন্দ্ব এতটা ভয়াবহ যে তার প্রভাব ছিল বিগত আন্দোলনে।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন দাবি করেন, ‘অনেক নির্যাতন-নিপীড়নের পরও আমাদের ৯০ ভাগ কর্মী রাজপথে থাকার চেষ্টা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা আমাদের অফিস বন্ধ করে দিলেও এখন আমরা আবার কার্যালয়ে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। আমাদের ১৮০ জন নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।’ স্থানীয় নেতাদের মধ্যে দূরত্ব নেই বলে দাবি করেন তিনি।

ঝালকাঠি

জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ হোসেনকে আহ্বায়ক ও মো. শাহাদাৎ হোসেনকে সদস্যসচিব করে ২০২০ সালের নভেম্বরে দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে বিএনপি। পরে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। তিন মাসের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি করার কথা থাকলেও তিন বছরেও তা হয়নি। আর আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় জেলা বিএনপি। এক পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন শাহজাহান ওমরপন্থি জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। অন্য পক্ষে বর্তমান জেলা সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসেন। যদিও জেলা বিএনপির রাজনীতিতে একসময় দলের ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন। কিন্তু তিনি দল ত্যাগ করায় বর্তমানে জেলা সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসেনের প্রভাব বেশি।

দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি চারটি উপজেলা ও দুটি পৌর কমিটিসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের সব সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেছে। এসব কমিটিতে নেতৃত্বে আছেন মূলত শাহাদাতের অনুসারীরা।

জেলা সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসেন  বলেন, জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে একাধিকবার পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কেন্দ্রের কাছ থেকে সময় না মেলায় এটি সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর বারবার বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বেশির ভাগ উপজেলায় তার লোক দায়িত্বে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ ভোটের মাধ্যমে যদি কেউ নির্বাচিত হন তিনি অবশ্যই দলের লোক, তিনি অবশ্যই তার লোক। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে বিভাগের মধ্যে ঝালকাঠির অবস্থান শীর্ষে বলেও মন্তব্য করেন। বলেন, তার বাড়িও ভাঙচুরের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ও তার পরিবার অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

পটুয়াখালী

কমিটি গঠনের প্রায় ৩ বছর ৩ মাস পার হলেও এখনো ৩১ জনের আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে পটুয়াখালী জেলা বিএনপি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় অনেক যোগ্য নেতা পদবঞ্চিত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর গঠন করা সেই আহ্বায়ক কমিটির হাত ধরেই ঢিমেতালে বিএনপির কার্যক্রম চলছে। অনেকটা একই অবস্থা দলের অঙ্গসহযোগী সংগঠন ছাত্রদল-যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দলেরও। যদিও জেলা শহরে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরকারি দলের হামলা ও পুলিশি বাধায় পড়তে হয়েছে। এক পক্ষকে পুরোপুরি বাইরে রেখে কয়েকটি উপজেলায় ‘পকেট’ কমিটি করার অভিযোগ করেছেন স্থানীয় এক নেতা।

পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্যসচিব স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ততা ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বারবার হামলার কারণে কমিটির কাজ করা সম্ভব হয়নি। বিগত দিনে ১৪ বার পার্টি অফিসে তারা হামলা করেছে। মামলা-হামলায় জর্জরিত নেতা-কর্মীরা। ইতোমধ্যে ১৪ ইউনিটের মধ্যে ১৩টিতে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, এত বড় দলে মান-অভিমান, অভিযোগ তো থাকবেই।

ভোলা

২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর ভোলা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র গোলাম নবী আলমগীরকে আহ্বায়ক ও সদর উপজেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাইসুল আলমকে কমিটির সদস্যসচিব করা হয়। ৫৮ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বেই বিগত কর্মসূচিগুলো পালন করা হয়। তবে পুলিশি বাধা ও পাহারায় বারবারই সীমিত আকারে করতে হয়েছে। তবে ২০২২ সালের ৩১ জুলাই ‘সারা দেশে লোডশেডিং ও জ্বালানি খাতে অব্যবস্থাপনার’ প্রতিবাদে ভোলায় বিক্ষোভ মিছিলে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আবদুর রহিম নামে এক স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা নিহত হন। এ ছাড়া ছয় পুলিশসহ অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন। গুলিবিদ্ধ জেলা ছাত্রদল সভাপতি নুরে আলম ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম নবী আলমগীর বলেন, ‘বরিশাল বিভাগের মধ্যে আমরা বেশ সক্রিয় ছিলাম। ঢাকার মহাসমাবেশ ও বিভাগীয় সমাবেশসহ সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। দলের নির্দেশনা অনুযায়ী সাধ্যমতো কর্মসূচি পালন করেছি। অসংখ্য মামলা নেতা-কর্মীদের নামে। সেই অর্থে বড় কোনো বিভেদ আমাদের মধ্যে নেই।’

বরিশাল বিএনপি

বরিশাল উত্তর-দক্ষিণ জেলা ও মহানগর মিলিয়ে জেলা বিএনপি যেন নেতায় ভরপুর। আর এ কারণেই নানা বলয়। তবে বিরোধের মূলে কেন্দ্রীয় দুই নেতা। একজন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার ও অন্যজন সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীন। বিভিন্ন কমিটি গঠন নিয়ে তাদের মতের ভিন্নতা অনেকটাই স্পষ্ট বলে জানা যায়। নিজেদের দল ভারী করতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও অনেক কিছু থেকে সারোয়ার নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন বলে জানা গেছে। তবে আধিপত্য বিস্তারে দুটি জেলা ও মহানগর সাংগঠনিক এলাকার নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ ও উপগ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। এসব গ্রুপ একপক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ফলে অনেক সময়ই কেন্দ্র ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচিগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী সফল হচ্ছে না।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *