বরিশাল অফিস :: এই জনপদে এক সময় নাম ছিল ভাঙন। কীর্তনখোলা গিলে খেয়েছে অসংখ্য ঘর-বাড়ি। বরিশালের সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নে সেই ভাঙন আতঙ্ক আর নেই। সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ বদলে দিয়েছে হুমকির মুখে থাকা এই এলাকার জীবন। ভাঙন ভয়ে এক সময় যারা এলাকা ছেড়েছিলেন, তারা ফিরেছেন। স্থায়ী বসতি গড়েছেন আরও অনেকে।
ইউনিয়নটিতে সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার ভাঙারপাড়ে আতঙ্ক কেটেছে, নেই হাহাকার, বদলে গেছে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা। বেড়িবাঁধ কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দর্শনীয় স্থান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, অবকাশ কেন্দ্র। মুগ্ধ করা পরিবেশে বিকেল হলেই হাজারো দর্শনার্থীর ঢল নামে। স্থানীয়রা ভাঙারপাড়কে এখন কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের সঙ্গে তুলনা করছেন। নাম দিয়েছেন— ‘মিনি কুয়াকাটা’।
জানা গেছে, চরবাড়িয়ার নদী ভাঙন ঠেকাতে ২০১৯ সালে তিন কিলোমিটার নদী তীর বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাত ধরে প্রথমে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজ শুরু হলেও সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং প্রকল্প যুক্ত করে প্রায় ১৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ শেষ হয় ২০২৩ সালে। এরপরই বদলে যেতে শুরু করে গ্রামটি।
প্রাণোচ্ছল আলাপ করছিলেন বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাঙারপাড়ের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম। কীর্তনখোলা নদীর তীরের পাশে নূরুল ইসলামের টিনেশেড ঘর। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। প্রাণোচ্ছল আলাপে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এই এলাকায় কম হইলেও এক কিলোমিটার গাও (গ্রাম) ভাঙছে। প্রত্যেকবার বর্ষাকালে মোগো (আমাদের) ঘরবাড়ি পানিতে তলাই থাকতো। বেড়িবাঁধ হওয়ার পর নিশ্চিন্ত। চাইরপাশ কুয়াকাটা হইয়া উঠছে।’
ভাঙারপাড় ঘুরে দেখা গেছে, গত ছয় মাসের ব্যবধানে সেখানে ৩০টিরও বেশি রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। নদী তীরে বসানো আছে ট্যুরিস্ট বেঞ্চ। আছে স্পিড বোট ও ট্রলার। বসানো হয়েছে চরকি, নাগরদোলা। প্রতিদিন বিকেল হলেই সেখানে হাজারো দর্শনার্থীর ঢল নামে।
স্থানীয় বাসিন্দা বাবুল মিয়া বলেন, ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াস যে তাণ্ডব চালায় তাতে আমরা ভেসে গিয়েছিলাম। তবে এবার রেমালে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বেড়িবাঁধটা হওয়ায় এখন অন্তত ভাঙনের ঝুঁকি কমেছে। যেহেতু নদী তীরে থাকি, জোয়ারে পানিতে তলিয়ে যাবে এটা স্বাভাবিক। তবে এখন আর বাপ-দাদার ভিটা ছাড়তে হচ্ছে না।
ভাঙারপাড়ে প্রাণচাঞ্চল্য ::
ট্রলার চালক সুমন বলেন, এখানে নদী দেখতে সুন্দর, শান্ত থাকে। তাই মানুষ ট্রলারে নদী ভ্রমণ করে। জনপ্রতি ২০-৩০ টাকা করে নিয়ে নদীতে ভ্রমণে যাই। প্রতি ট্রিপে এক ঘণ্টার মতো থাকি।
নীলা সাহা ঘুরতে এসেছেন ভাঙারপাড়ে, আলাপে তিনি বলেন, আমার কাছে কুয়াকাটার চেয়ে কীর্তনখোলা নদীরপাড় ভালো লাগে। নির্মল বাতাস, গ্রামীণ পরিবেশ, শান্ত নদী। এখানে পরিবার নিয়ে সময় কাটানো সেরা। সুযোগ পেলেই আমি এখানে আসি। বেড়িবাঁধে বসে নদীর জলে পা ভেজাই।
একটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক রিয়াজ উদ্দিন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বেড়িবাঁধ হওয়ার পর কয়েকজন বন্ধু মিলে ঘুরতে এসে দেখলাম ব্যবসার জন্য জায়গাটা উপযোগী। এরপর আমরা সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় নেমেছি। এখানে অধিকাংশ রেস্তোরাঁ জমি ভাড়া নিয়ে করা হয়েছে।
কাওছার হোসেন নামে এক দর্শনার্থী বলেন, এখানে পরিবেশটা সুন্দর। অধিকাংশ মানুষ নদীপাড়ে হাঁটতে আসেন কিন্তু বেপরোয়া মোটরাসাইকেল চলাচলের কারণে ভয়ও আছে। অনেক মোটরসাইকেলচালক ইচ্ছে করে দর্শনার্থীদের বিরক্ত করেন। গত শুক্রবার পরিবারসহ এসেছিলাম। ওই দিন এক বখাটের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আমার শ্যালিকা নদীতে পড়ে যায়।
বরিশাল মেট্রোপলিটন কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান বলেন, চরবাড়িয়া ভাঙারপাড় এলাকায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ যান। অবসর কাটাতে আসা মানুষেদের এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তায় সবসময়েই সেখানে পুলিশ ফোর্স নিয়োজিত রাখা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন অলীদ বলেন, বেড়িবাঁধটি বড় ধরনের ভাঙনের হাত থেকে ওই এলাকাকে বাঁচিয়েছে। এখন বাঁধ রক্ষা করা এলাকাবাসীসহ সকলের দায়িত্ব। বেড়িবাঁধে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। এছাড়া ট্রলার-স্পিড বোট ভেড়ানোও নিষিদ্ধ। সেখানে মোটরসাইকেল যেন চলাচল করতে না পারে সে জন্য আমরা ব্যবস্থা দিয়েছি। ট্রলার-স্পিড বোট নিয়ে সাইনবোর্ড দেওয়া আছে। নিয়ম উপেক্ষা করে যদি কেউ বেড়িবাঁধের ক্ষতি করে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।