শিরোনাম

বন্যার্তদের পাশে বরিশালের মুসলিম, হিন্দু ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির বাংলাদেশ

Views: 28

বরিশাল অফিস :: ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লহ্মিপুর, খাগড়াছড়িসহ বন্যা দুর্গত এলাকায় জরুরী খাবার, ঔষধসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ ও বিধ্বস্ত এলাকার মানুষদের পূনর্বাসনের লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

বন্যা মোকাবেলায় ৫০টির বেশি নৌকা ও স্প্রিডবোট নিয়ে দূর্গত এলাকায় ছুটে বেড়াচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীসহ আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ও মানবিক জনগণ। তারই ধারাবাহিকতায় ছাত্র জনতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাঠে নেমেছে বরিশালের বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, মন্দিরের পূজারী, পুরোহিত ও আলেম সমাজ এক সকল সকল শ্রেণী পেশার মানুষ হিন্দু, মুসলিম,খ্রীষ্টান কোন ভেদাভেদ নাই । সবাই যে যার অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে।

বরিশালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক নাভিদ নাসিফ জানিয়েছেন, গত ২২ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের সংগ্রহ হয়েছে ১ লক্ষ ৭৩ হাজার ১৪০ টাকা। শুক্রবার আমরা ১২ জনের গ্রপে বিভক্ত হয়ে বরিশালের ৭০টির বেশি মসজিদের সামনে চাঁদা তুলেছি। তবে টাকা পরিমাণ এখনো হিসাব করা হয়নি এক সাথে করে সকলের কাছে জানানো হবে।

এদিকে শুক্রবার বরিশালের সড়কে বাজারে মসজিদের সামনে দানবাক্স হাতে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীসহ আলেম সমাজের অনেককেই। ইসলামি আন্দোলন যুব আন্দোলন নেতা মোঃ সানাউল্লাহ জানান, তাদের চরমোনাই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও ইসলামি আন্দোলনের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ের সব মসজিদ ও বাজার থেকে দান সংগ্রহ করছেন।

এদিকে বরিশালের বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, শুধু কথায় নয়, ওরা কাজেও সবাই বৈষম্য বিরোধী। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে ওরা কিশোর যুবকরা এসে দাঁড়িয়েছে মসজিদের সামনে। সকলের হাতে দানগ্রহণের বাক্স। ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা, লহ্মিপুর অঞ্চলের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সাহায্য চাচ্ছে ওরা। শুক্রবার (২৩ আগস্ট)জুম্মার নামাজের আগমুহূর্তে বরিশাল নগরীর প্রায় সব মসজিদের সামনে ছিলো বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের এই দানগ্রহণ দৃশ্য। তাদের মধ্যে মাদ্রাসার ছাত্র যেমন আছে, তেমনি আছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বিএম কলেজ এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর শিক্ষার্থী। আবার হিন্দু, খ্রিস্টান এবং মুসলমান ঘরের সন্তান ওরা সম্প্রীতির এক অনন্য বন্ধন তৈরি করেছে এই বন্যার্তদের ঘীরে। জুম্মার আগমুহূর্তে বরিশালের আমতলা মোড়ের খান সড়কে খান বাড়ি জামে মসজিদের সামনে দাঁড়ানো ৭-৮ জনের একটি টিম।

টিমের একজন নাম আলবার্ট গোমেজ জয় তিনি জানান, তোরা যা, নামাজ পড়ে আয়। আমি এগুলো পাহারা দিচ্ছি। যে বলছে, সে একজন খ্রিস্টান শিক্ষার্থী। ওর পাশেই এসে বসলো তন্ময় নামের হিন্দু শিক্ষার্থী। বললো, তুই একা না আমিও আছিতো। আর মুসলিম বন্ধুরা হেসে ওদের মাথায় দান বাক্স বসিয়ে মজা করার চেষ্টা করে নামাজে চলে গেলেন। পাশে বসে কথা বলে জানা গেল, গতদিন সন্ধ্যায় ওরা মন্দিরের সামনে এভাবে দান নিয়েছে। আর আগামী রবিবার চার্চে বা গীর্জায় যাবে সবাই।

এদিকে তখন মসজিদের ঈমাম মাওলানা আবুল কাসেম বিন নুর ঠিক আযানের পরপরই তার জুম্মার বয়ান শুরু করে দিয়েছেন। মিথ্যাবাদী আর জালেম কখনো মুসলমান হতে পারেনা। আল্লাহ যুগ যুগ ধরে এদের সুযোগ দিয়েছেন এবং যখন পাকড়াও করেছেন তখন তার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। তিনি এ সময় ভারতের নোটিশ না দিয়ে বাঁধ খুলে দেয়ার নিন্দা জানান।
ঈমাম আবুল কাসেম তার খুতবা শেষে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের দানগ্রহন করতে আসার তথ্য জানিয়ে, মুসল্লীদের কাছে বন্যার্তদের সহযোগিতায বেশি বেশি দান করার আহ্বান জানান।

এ সময় আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ভূমিকার প্রশংসা করে ঈমাম বলেন, বরিশাল ঈমাম সমিতির পক্ষ থেকেও দানগ্রহণ করা হচ্ছে। এ নিয়ে জরুরী মিটিং ডেকেছেন মহানগর ঈমাম সমিতি। নামাজ শেষ হতেই বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন দানবাক্স হাতে নিয়ে। সাতজনের হাতে সাতটি দানবক্স। পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে আরো কয়েকজন সহপাঠী। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বাক্সের গায়েই লেখা আছে – “ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লাসহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহযোগিতায় দান করুন। ” প্রতিটি মসজিদে ছিলো বাংলাদেশের জন্য এবং বন্যার্ত মানুষের জন্য বিশেষ দোয়া মোনাজাত।

সুন্দর সুশৃঙ্খল তাদের এই দানগ্রহণ শুক্রবার নগরীর প্রায় সব মসজিদের প্রবেশপথে দেখা গেছে বলে জানালেন বরিশাল জেলা ঈমাম সমিতির সভাপতি মাওলানা আব্দুল মান্নান। তিনি জানান, মসজিদের ভিতরে ঈমাম সমিতির সদস্যরা দান তুলেছে, বাহিরে শিক্ষার্থীরা দানবাক্স হাতে দান তুলেছে। আল্লাহর রহমতে এই দুর্যোগ বেশিদিন স্থায়ী হবে না। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ ও সয়ংসম্পুর্ন একটি দেশ হবে ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন, আগামী সোমবার মিটিং এর পর ঈমাম সমিতির দানও দূর্গত এলাকায় পৌঁছে যাবে বলে জানান মাওলানা আব্দুল মান্নান।

এদিকে থেমে নেই বরিশালের হিন্দু সমাজও। তারাও তাদের মতো করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছেন। মুসুলমান-হিন্দু থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চাঁদা উত্তোলন করছেন। পাশাপাশি অনেকে আবার যা চাঁদা উঠেছে তা নিয়েই বন্যার্তদের পাশে ছুটে গিয়েছেন।

এর আগে ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার নগরীর শ্রী শ্রী শংকর মঠ পূজা উদযাপন কমিটিসহ ৫টি মন্দিরের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যের স্বেচ্ছাসেবক দল বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। দুর্গোৎসবের জন্য উত্তোলনকৃত চাঁদার একটি অংশ তাদের মাধ্যমে বন্যার্তদের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানান তন্ময় দাস।

এছাড়া নগরীর ২৭ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণারঞ্জন চক্রবর্তীর স্মৃতি দুর্গা মন্দির কমিটিও আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অর্থ সহায়তা দিয়েছে। শ্রী শ্রী শংকর মঠ পূজা উৎযাপন কমিটির সভাপতি লিমন কৃষ্ণ সাহা কানু ও সাধারন সম্পাদক আকাশ দাশ বলেন, প্রতি বছর দূর্গোৎসব ঘিরে বড় আয়োজন থাকে তাদের মন্দিরে। এ জন্য বছরের শুরু থেকেই উৎসবের আয়োজনে চাঁদা উত্তোলন করা হয়। এ বছর কুমিল্লা ও ফেনীসহ ৮টি জেলায় যেভাবে পানি প্রবাহিত হচ্ছে তাতে করে উৎসব আগে না মানবতা আগে। সেই বিবেচনার দিক থেকেই শ্রী শ্রী শংকর মঠ এবং নগরীর আরো বেশ কিছু মন্দিরের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা বন্যার্তদের জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছে।

তারা আরো বলেন, কারন এ ধরনের দুর্ভোগ সব সময় থাকবে না। কিন্তু এ দুর্ভোগ থেকে আমাদের দেশকে বাঁচানোর দায়িত্বও আমাদের। সেই স্থান থেকেই মন্দিরের পক্ষ থেকে বণ্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি আমরা। তাছাড়া নগরী এবং জেলার সকল মন্দির কমিটির সদস্যদের তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে চাঁদা দিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। সকলেই তাতে সাড়া দিয়ে প্রতিটি মন্দিরের সভাপতি ও সম্পাদক সেই টাকা এক জায়গা করে স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে বন্যাদুর্গদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন বলে জানা গেছে।

বরিশাল নগরীর দক্ষিণারঞ্জন চক্রবর্তীর স্মৃতি দুর্গা মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক অয়ন চক্রবর্তী বলেন, উৎসব প্রতি বছর করা যাবে। এ বছর প্রয়োজনে ছোট আকারে করা হবে। কিন্তু যারা মারাত্মক দুর্ভোগে রয়েছেন তাদেরকে আগে রক্ষা করতে হবে। এ জায়গা থেকেই আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দুর্গোৎসবের জন্য উত্তোলনকৃত চাঁদা প্রেরন করা হয়েছে। এছাড়া তাদের গোত্রের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছে বলে জানান তিনি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সকারি বিএম কলেজ, ইসলামি আন্দোলন, ছাত্রদল বরিশাল থেকে শুরু করে নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জুম্মা বাদ মসজিদের সামনে বন্যার্তদের জন্য চাঁদা উত্তোলন করেন। এ সময় তাদের সাথে মুসুলমান, হিন্দু ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা এ চাঁদা আদায়ে অংশগ্রহন করে। যা ছিলো সম্প্রীতির বাংলাদেশ এর অনন্য উদাহরণ।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *