বরিশাল অফিস:: ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে বরিশাল নগরীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা কলোনীকে ব্যবহার করা হতো বরিশাল বিভাগের পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রধান সামরিক ঘাঁটি হিসেবে। যার দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তান হকি টিমের ক্যাপ্টেন কর্নেল আতিক। বিভাগের সবগুলো জেলায় এখান থেকেই অপারেশন পরিচালনা করা হতো। ওয়াপদা কলোনীর ১৩টি ভবন পাকিস্তানী সৈন্য ও আল-বদর রাজাকারদের দখলে থাকলেও দুটি ভবন ব্যবহার করা হতো টর্চার সেল হিসেবে। এরমধ্যে একটি ছিল নারী নির্যাতনের জন্য।
আরেকটি পুরুষদের নির্যাতনের জন্য। এখানে কোনো পুরুষ বাঙালি কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আসার পর তাকে ২৪ ঘন্টার বেশি বাঁচিয়ে রাখা হতো না। কলোনী সংলগ্ন সাগরদী খালের ওপরের ব্রিজে তুলে বা কখনো খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। এসব খুব কাছ থেকে দেখেছেন ওয়াপদা কলোনীর বাসিন্দা ফিরু বেগম। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। তার বাবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্পিডবোট চালক ছিলেন। যে কারণে খাল লাগোয়া বড় বিল্ডিংটির দ্বিতীয় নম্বর কক্ষে থাকতেন তারা। দেশ আক্রমণের পর তাদের পরিবারকে ‘ডান্ডি কার্ড’ দেওয়া হলে কোয়ার্টারে থাকতে এবং চলাফেরা করতে তাদের কোন সমস্যা হতো না। তারপরেও তার মা সব সময় আতঙ্কে থাকতেন।
ঘরের চৌকির নিচে বিছানা পেতে সেখানেই সকলকে শোয়ায়ে রাখতেন। ফিরু বেগম বলেন, সাল তারিখ ঠিক মনে নেই। দেশে যুদ্ধ লেগে গেছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ওয়াপদা কলোনীর অধিকাংশ বাসিন্দারা নিরাপদে চলে যান। কিন্তু আমার আব্বা স্পিডবোট চালক থাকায় তিনি চাইলেও যেতে পারলেন না। তাকে ডান্ডি কার্ড দেওয়া হলো। একদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি মিলিটারিরা ওয়াপদা কলোনী দখলে নিয়েছে। আরেকদিন দেখি খালের পাড়ে বড় বড় চারটি বাঙ্কার তৈরি করছে। আমরা বুঝতাম না ওগুলো কি। মিলিটারিরা যখন এসব বানাচ্ছিল তখন ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতাম। তারা চলে গেলে আমিসহ ছোট ছোট যে কয়জন ছেলে-মেয়ে কোয়ার্টারে থাকতাম তারা দৌঁড়ে আসতাম। আব্বা আমাদের ধমকাতেন আর বলতেন, কখনো যেন মিলিটারিদের সামনে না পরি। তখন আব্বাই বলেছিলেন, ওইগুলো বাঙ্কার।
ফিরু বেগম বলেন, পুরোদমে যুদ্ধ শুরুর পর কখনোই আমরা রুমের বাহিরে বের হতে পারতাম না। আমার ভাই দেলোয়ার হোসেন তখন কলেজের ছাত্র। আব্বা সরকারি চাকরি করেন, আমাদের ডান্ডি কার্ড আছে, এসবের কারণে সে (দেলোয়ার) আর ঘরে থাকতো না। সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে যেত। একদিন মিলিটারি আমাদের ঘরে এসে ভাইকে ধরে নিয়ে ঘরের সামনে বেঁধে রাখলো। মিলিটারি আমাদের জানালো তারা দেলোয়ারের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় পেয়েছে। মা-বাবার তখন কিছুই করার ছিল না। ভাইকে ঘরের সামনের আম গাছের সাথে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করা হলো। শেষে আমার ভাইসহ আটক অন্যান্যদের গুলি করার জন্য পাক সেনারা কীর্তনখোলা নদীর তীরে নিয়ে গেল। কিন্তু দেলোয়ারকে গুলি করার জন্য দাঁড় করালেও গুলি করার আগেই সে নদীতে ঢলে পরে যায়। এরপর নদীতে ভাসতে ভাসতে দূরে গিয়ে উঠে ভিজা কাপড়ে আব্বার অফিস বগুড়া রোডে গিয়ে ওঠে। আব্বা দেলোয়ারকে ওয়াপদা কলোনীতে না এনে তার এক বন্ধুর বাসায় আটকে রাখেন।
এভাবে তিন মাস সেখানে থাকলেও একদিন দেশ মাতৃকার টানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেলোয়ার পালিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে নগরীর অক্সফোর্ড মিশন রোড এলাকায় বসে মিলিটারির হাতে ধরা পরার পর ৭ ডিসেম্বর দেলোয়ারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ফিরু বেগম আরও বলেন, টর্চার সেলের সকল নৃশংসতা আমি দেখেছি। খালের পাড়ে আমাদের বাসা থাকায় প্রতিদিন লাশ ভাসতে দেখতাম। প্রতিদিন আসরের আজানের পর আমাদের বাসার সামনে থেকে সারিবদ্ধভাবে আটক মুক্তিযোদ্ধা ও নিরিহ বাঙালিদের ব্রিজের ওপর নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। তিনি আরও বলেন, রাত হলে নারীদের টর্চার সেল থেকে করুণ চিৎকার, কাকুতি-মিনতি, কান্নার শব্দ ভেসে আসতো। আমরা কেউ ঘুমাতে পারতাম না। মনে হতো নরকের মধ্যে আছি। যেখানে প্রতিটি মুহুর্ত অন্যের মৃত্যু দেখেছি। সেসব স্মৃতি মনে পরলে এখনও ভয়ে আতঁকে উঠি।
উল্লেখ্য, বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয় ওয়াপদা কলোনীতে। এখানে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের ঘটনার পাশপাশি গণকবরের কথাও জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাক সেনাদের কবল থেকে ওয়াপদা কলোনী উদ্ধারের নেতৃত্ব দেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রদীপ কুমার ঘোষ পুতুল, পরিমল কুমার ঘোষ, এএমজি কবির ভুলু জানিয়েছেন, এখানে ১০ হাজারের মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তবে কতোজন নারী বন্দী ছিলেন তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।
বরিশাল নগরীর ওয়াপদা কলোনী দেশের বড় বড় টর্চার সেল ও গণহত্যার কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি। ২০১২ সালে ওয়াপদা কলোনী সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরন। কিন্তু তার অকাল মৃত্যুর ফলে সেই উদ্যোগ আর অগ্রসর হয়নি। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির মুখে ২০২০ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ চার কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়াপদা কলোনীর বধ্যভূমি সংরক্ষণ করেছেন।