চন্দ্রদ্বীপ ডেস্ক :: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও তার সরকার পতনের পর আত্মগোপনে থাকা বরিশালের ৭ এমপি‘দের নিয়ে নানা আলোচনা –সমালোচনার শেষ নেই। ইতোমধ্যে রাশেদ খান মেনন ও বরিশাল সদর আসনের এমপি সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহিদ ফারুক গ্রেপ্তার হয়ে কারান্তরীন হয়েছেন। অন্যদের মধ্যে কেউ আছেন দেশে আত্মগোপনে। আবার কেউ ক্ষমতা ছাড়ার আগে-পরে পাড়ি জমাতে সক্ষম হয়েছেন প্রতিবেশী দেশ সহ বিদেশে। অনেকে আবার দেশত্যাগ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হবার দিন কয়েক পরেই।
তবে বরিশালের ৬টি সংসদীয় আসন ছাড়াও একটি সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি কোন দিনই এলাকার নিদিষ্ট লোকদের বাইরে আমজনতা সহ এলাকার উন্নয়ন ও ভালমন্দের তেমন কোন খোজ খবর রাখতেন না বিধায় তাদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি এলাকার রাজনীতিতে এখনো তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। নির্বাচিত ৬ এমপি’র মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত বরিশাল-২ আসনের রাশেদ খান মেনন একাধিকবারের পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। তবে তিনি অন্যদের তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রমও ছিলেন। এমপি বা মন্ত্রী অবস্থায় তিনি নিজ এলাকা ছাড়াও নির্বাচনী এলাকা এবং বরিশালের যেকোনো মানুষের উপকারের চেষ্টা করে গেছেন। মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে বরিশালের উন্নয়নে সম্ভব সবকিছু করারও চেষ্টা করেছেন মেনন।
তবে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও অংগ সংগঠন যাকে এতদিন ‘দক্ষিণাঞ্চলের অভিভাবক’ হিসেবে উল্লেখ করতেন, সেই বরিশাল-১ আসনের এমপি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ছাত্র আন্দোলনের শুরুতেই দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। দীঘ রাজনৈতিক জীবনে আবুল হাসনাত সব সময়ই বিপদের আগাম আঁচ করতে পারেন বলে খ্যাতি আছে। এবারো তিনি আন্দোলনের শুরুতেই মুম্বাইতে মেয়ের বাড়ীতে চলে গেছেন। অতীতে ভারতে অবস্থানকালে তিনি বেশীরভাগ সময়ই আজমির শরিফে অবস্থান করে এবাদত বন্দেগীতে রত থাকতেন। এবারো তার অন্যথা হচ্ছে না বলে ঘনিষ্ঠজনেরা মনে করছেন। তবে ইতোমধ্যে নিজ এলাকা আগৈলঝাড়াতে এক ছাত্রদল নেতাকে ক্রস ফায়ারে হত্যার দায়ের পুলিশের ডিঅইজি ও এসপি সহ কয়েকজনের নামের মামলায় আবুল হাসনাতের নামও উঠে এসেছে।
বরিশাল-৩ আসনে আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্র গোলাম কিবরিয়া টিপু’র কোন খোজ নেই। যদিও তিনি ক্ষমতার আমলেও এলাকার তেমন কোন খোজ খবর রাখতেন না। তবে ক্ষমতা হারানো সরকারী দলের কোটায় নির্বাচন করে এমপি হওয়া আস্থা-ভাজন বিরোধী দলের এ নেতাও এখন অনেকটা নিরুদ্দেশ। তিনি দেশে না বিদেশে তাও বলতে পারছেন না ঘনিষ্ঠজনেরা।
এমনকি বরিশাল-৪ আসনের এমপি পংকজ দেবনাথও নিরাপদে ভারতে পালিয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকেই। তার বিরুদ্ধেও দু বছর আগে বিএনপি অফিসে হামলা,ভাংচুর ও লুটপাটের অভিযোগ মামলা হয়েছে। দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাম্মি আহমদ সুপ্রিম কোট থেকে অযোগ্য ঘোষিত হলেও পরে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। শাম্মি আহমদ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া অবস্থান করছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানালেও ৫ আগস্টের পরে তার নিশ্চিত অবস্থান নিকটজনদেরও অজানা। অস্ট্রেলিয়ার পাসপোটধারী শাম্মির সন্তানেরা সেখানেই বসবাস করছে বলে জানা গেছে।
বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম গত ২ আগস্ট সর্বশেষ এলাকায় এসে খুব অল্প সময় অবস্থানের পর ঢাকায় ফিরে যান। ৩ আগস্ট তার বাড়ীতে হামলা ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে। সরকার পতনের পরে ঢাকায় অবস্থান করলেও বরিশাল জেলা এবং মহানগর বিএনপি অফিসে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মামলায় তাকে সম্প্রতি ঢাকা থেকে গ্রেপ্তারের পরে বরিশালে নিয়ে আসা হয়। পরে মহানগর বিএনপি’র শান্তি-সংহতি মিছিল এবং দলীয় নেতা জিয়া-উদ্দিন শিকদার সহ অন্যান্যদের ওপর হামলার অভিযোগে আরো একটি মামলায় জাহিদ ফারুককেও আসামী করা হয়েছে।
বাকেরগঞ্জ উপজেলা ও পৌরসভা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৬ আসনে প্রথমবার নৌকার টিকিট নিয়ে এমপি হওয়া অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুল হাফিজ মল্লিক-এরও কোন খোঁজ নেই। সরকার পতনের পরে এলাকার ঘনিষ্ঠজনেরও তার অবস্থান জানেন না। এলাকায় অনেকটা বসন্তের কোকিল হিসেবে পরিচিত হাফিজ মল্লিক নির্বাচন এলেই এলাকার মানুষের খোজ খবর রাখতেন বলে খ্যাতি আছে। এখনো তার অন্যথা হচ্ছেনা বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক-গন মনে করছেন। তবে এখনো কোন মামলায় তার নাম আছে বলে জানা যায়নি।
মহানগরীর বগুড়া রোডের বাসিন্দা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা আমীর হোসেন আমু ঝালকঠী সদর ও নলছিটি উপজেলা নিয়ে গঠিত ঝালকাঠি-২ আসনের এমপি হলেও বরিশালের রাজনীতি সহ সব কিছুতেই সুদূর অতীত থেকে প্রভাব বিস্তার করে ছিলেন। তবে সদ্য পট পরিবর্তনের পরে তারও কোন খোঁজ নেই। ইতোমধ্যে বরিশাল ও ঝালকাঠিতে তার বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ঝলকাঠীর বাসায় আগুন নেভাতে গিয়ে দমকল কর্মীরা নগদ ৫ কোটি টাকাও উদ্ধার করেছেন। পোড়া গন্ধ আর ধ্বংসস্তুপের শুনশান নীরবতায় দাড়িয়ে আছে বরিশাল ও ঝালকাঠিতে আমীল হোসেন আমুর সুরম্য অট্টালিকা। কেউ বলছেন তিনি ভারতে পালিয়েছেন, আবার কেউ বলছেন দেশেই অবস্থান করছেন।
নিরুদ্দেশ আছেন সাম্প্রতিককালে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদেক আবদুল্লাহ’ও। আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাদেক আবদুল্লাহ ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে তার বাসভবনে হামলার আগেই ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান এরপরে আর কোন সন্ধান নেই। তবে তার বাসায় হামলা ও অগ্নি সংযোগের পরে সেখান থেকে সাবেক কাউন্সিলর লিটু সহ ৩ জনের মৃতুদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
এভাবেই নিকট অতীতের একেকজন লৌহমানব ও সিংহ পুরুষেরা ক্ষমতা হারাবার পরে কেউ নিরাপদ আশ্রয়ে, আবার কেউ নিরাপদে থাকার লক্ষে ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
তবে যেহেতু দল আর ক্ষমতায় নেই, তাই তাদের নামের আগে-পরে এখন আর কোন তকমা নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মহলের মতে, ‘ক্ষমতা কি জিনিষ তা ইতোমধ্যে টের পেতে শুরু করেছেন বরিশালের সিংহ পুরুষ সহ নানা বিশেষণে অভিষিক্ত সদ্য ক্ষমতা হারানো নেতারা। ক্ষমতা এতদিন তাদের উত্থানের চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে গেলেও তার ফলও এখন তারা ভোগ করছেন’ বলেও মনে করছেন বিশ্লেষক-গন।