শিরোনাম

বরিশালের সাবেক এমপি শাহে আলমের শতকোটি টাকা আত্মসাৎ

Views: 30

বরিশাল অফিস :: বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন শাহে আলম তালুকদার। নব্বইয়ের দশকে এরশাদ সরকার পতন আন্দোলনের রাজপথ কাঁপানো এই ছাত্রনেতা ২০১৮ সালে বরিশাল-২ (বানারীপাড়া ও উজিরপুর) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। এমপি হওয়ার পর পাঁচ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দরিদ্রজন জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন তহবিল থেকে নেওয়া শতকোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া নামে-বেনামে, দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।

বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য গত বছর তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও করেছিল বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় নির্মাণের ৫৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এমপি হওয়ার পর ভাগ্যবদল ::
সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী অস্থাবর সম্পদের তালিকায় শাহে আলম ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা মূল্যমানের একটি গাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে ২০১৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর অর্ধকোটি টাকা মূল্যমানের নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে এলাকায় আসেন শাহে আলম। এরপর বছর না যেতে তার গাড়িবহরে যুক্ত হয় ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো। শুল্কমুক্ত সুবিধায়ন আনা ওই গাড়ির তৎকালীন মূল্য ছিল প্রায় দুই কোটি টাকা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ‘এমপি’ নামক আলাউদ্দিনের চেরাগের ঘষায় শাহে আলমের ভাঙা টিনের ঘরেরও পরিবর্তন আসে। বাবা সাইজুদ্দিনের জরাজীর্ণ টিনের ঘর ভেঙে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন প্রাসাদসম ডুপ্লেক্স বাড়ি। একই সময়ে ওই বাড়ির বিপরীতে থাকা তিন শতাংশ সরকারি খাস জমি দখল করে নির্মাণ করে ব্যক্তিগত বৈঠকখানা এবং নিজস্ব কর্মচারী ও ড্রাইভারদের জন্য দ্বিতল ভবন। সরকারি খাল দখল করে নির্মাণ করেন সীমানাপ্রাচীর। এ নিয়ে কয়েকবার উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শতকোটি টাকা আত্মসাৎ::
শাহে আলম এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের মালিকানাধীন এসএম ফাউন্ডেশনের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প থেকে নেওয়া শতকোটি টাকা ঋণ নেন। কিন্তু ঋণের অর্থ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। জনশ্রুতি রয়েছে, ওই টাকাসহ বিপুল পরিমাণের অর্থ তিনি কানাডায় পাচার করেছেন। সেখানে গড়ে তুলেছেন বাড়ি, কিনেছেন গাড়ি। কানাডায় শিক্ষা ভিসা নিয়ে তার দুই ছেলে বসবাস করছেন। মাঝেমধ্যে তিনি সেখানে গিয়ে অবকাশকালীন পার করতে যেতেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহে আলমের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জানান, এর আগে ১৯৯৬ সালেও ওই ফাউন্ডেশনের নামে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ছিলেন আলম। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ওই সময় দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১৯৯৬ সালে নেওয়া শতকোটি টাকার ঋণ মওকুফ আবেদন করেন তিনি।

হিন্দুদের বাড়ি ও সম্পত্তি দখলের চেষ্টা :: 
২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর সড়ক সংস্কার ও প্রশস্তকরণের কারণ দেখিয়ে ভেঙে ফেলেন বিপ্লবী কুমুদ বিহারী গুহ ঠাকুরতার সমাধির সীমানা দেয়াল ও স্মৃতিস্তম্ভের একাংশ। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পরে তিনি সমাধিটি সংস্কার করেন। ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামে জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতার পারিবারিক সম্পত্তি দখল করেন শাহে আলম। একই বছরের ২৪ জানুয়ারি উপজেলার পশ্চিম তেতলা গ্রামে ১২ পরিবারের কয়েক একর জমি দখলের চেষ্টা করেন আলম। জমির দলিল লিখে নেওয়ার জন্য কৃষক রতন ঘরামীকে ঘরে আটকে রেখে রাতভর নির্যাতন করে শাহে আলমের বাহিনী। পরের দিন ভোরে ৯৯৯ খবর পেয়ে রতন ঘরামীকে উদ্ধার করে পুলিশ। ২৫ জানুয়ারি দুপুরে লোমহর্ষক সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বরিশাল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন রতন ঘরামী। ওই ঘটনায় আদালতে রতনের করা মামলার এখনো তদন্ত করছে পিআইবি। এদিকে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল ও নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে একুশের গানের রচয়িতা প্রয়াত ভাষাসৈনিক আবদুল গাফফার চৌধুরী বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লেখেন।

ঠিকাদারি কাজ ভাই-ভাগনে, কমিশন ৫-১৮ পার্সেন্ট :: ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বরিশাল-২ আসনের বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলায় ব্রিজ-কালভার্ট, আয়রন সেতু, সড়ক নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ এবং সংস্কারসহ অবকাঠামো উন্নয়নে কমপক্ষে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এর অধিকাংশ প্রকল্পের ঠিকাদার ছিলেন তার ভাই, ভাগনে ও চাচাতো ভাইয়েরা।

প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, বানারীপাড়া ঠিকাদারি কাজ করতে হলে ৫-১৮ পার্সেন্ট টাকা শাহে আলমকে দিতে হতো। সে তার ভাই-ভাগনে কিংবা অন্য যে কেউ হোক না কেন। কমিশনের ওই টাকা তিনি সংগ্রহ করতেন প্রকৌশলীদের মাধ্যমে।

রাসেল আহমেদ নামে এক ঠিকাদার বলেন, ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টের (ইজিপি) কোনো ঠিকাদার কাজ পেলেও তিনি তা করতে পারতেন না। ওই কাজ নিজের পছন্দের লোকদের জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করাতেন শাহে আলম। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে অন্য কোনো ঠিকাদার কাজ পেলেও সেখানে অংশীদার হিসেবে ভাই-ভাগনেকে রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। তার পক্ষে ঠিকাদারি বাণিজ্যের পুরোটা তদারকি করতেন চাচাতো ভাই নুরুল হুদা তালুকদার ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সুব্রত কুণ্ডু, আওয়ামী লীগ নেতা সামশুল আলম মল্লিক, ভাই রিয়াজ তালুকদার, ভাগনে রুথেন মোল্লা, চাচাতো ভাই মামুনুর রসিদ স্বপন।

চাঁদাবাজি ছিল শাহে আলমের নিয়মিত ঘটনা ::
বানারীপাড়া ও উজিরপুরের একাধিক ব্যবসায়ী ও ইটভাটার মালিকরা জানান, শাহে আলম এমপি থাকাকালে সলিয়া বাকপুরে আবদুর রব কেন্দ্রীয় ঈদগাহ নির্মাণ ও বানারীপাড়া সরকারি পাইলট বিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে নামে সবচেয়ে বড় অঙ্কের টাকা চাঁদাবাজি করেছেন শাহে আলম। দুই উপজেলার ১০০টির ওপরে ইটভাটা রয়েছে। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে নামে প্রতিটি ইটভাটা থেকে তিনি গড়ে ১ লাখ টাকা চাঁদা হিসেবে নিয়েছেন। এ ছাড়া বছরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে বছরে আরও ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নিতেন ইটভাটা থেকে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্য ::
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে শাহে আলমের বাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট। বানারীপাড়া বালিকা বিদ্যালয় ও উজিরপুরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আদালতে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলাও হয়েছিল।

স্থানীয়দের দমাতে হাতুড়ি বাহিনী ::
আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় এবং বিরোধীদের দমন করতে গড়ে তুলেছিলেন হাতুড়ি বাহিনী। ‘এমপি’ শাহে আলমের অকর্মের বিরুদ্ধে কেউ যাতে কথা বলতে না পারেন, সে জন্য সে সময় চাচাতো ভাই নুরুল হুদার নেতৃত্বে এই হাতুড়ি বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি।

স্থায়ী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জানান, নুরুল হুদার নেতৃত্বের হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাওলাদ হোসেন সানার লিজ নেওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়। পরবর্তী সময়ে সেটা প্রশাসনের মধ্যে গড়িয়ে দেন সাবেক এমপি শাহে আলম। রাজাকারের লিস্টে তার বাবার নাম থাকা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় চাখার ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য সৈয়দ আতিকুর রহমান বাপ্পিকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে একটি পা ভেঙে দেয় শাহে আলমের বাহিনী। এই বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন উপজেলার উদয়কাঠি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য জাকির হোসেন, বাইশারী ‍ইউনিয়নের সাবেক সদস্য সোহেল।

সৈয়দ আতিকুর রহমান বাপ্পি বলেন, ‘শাহে আলম গেজেটভুক্ত রাজাকারের সন্তান উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দিলে ২০১৯ সালের ঈদের আগের দিন নুরুল হুদার নেতৃত্বে হাতুড়িপেটা করে আমার ডান পা অচল করে দেয়। এ নিয়ে থানায় মামলা করলে শাহে আলম বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে তা তুলে নিতে বাধ্য করেন।’

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগের নোটিশ :: শাহে আলমের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভার হয়। সভায় শাহে আলমের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগ এনে ২০২৩ সালে ৩ অক্টোবর সভাপতি মো. গোলাম ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাওলাদ হোসেন সানা স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়। ওই নোটিশে উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় নির্মাণের ৫৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ, উন্নয়নকাজে ৫ ভাগ হারে কমিশন আদায়সহ ১৭টি অভিযোগ তুলে ধরা হয়।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল সালম বলেন, এ বিষয়গুলো ‍আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল।

হতে চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা :: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারদের তালিকায় এসেছিল শাহে আলমের বাবা ডা. সায়েদ উদ্দিন তালুকদারের নাম। এমপির প্রভাব খাটিয়ে বাবার নাম বাতিলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। তাই শাহে আলম নিজেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় বেইজ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বেনী লাল দাসগুপ্তসহ ২০ মুক্তিযোদ্ধার স্বাক্ষরিত এক চিঠি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্তি হয়নি।

গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর শাহে আলম তালুকদারের নানা :: অনিয়ম-দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় জনতার হাতে মারধরের শিকার হয়ে গুলশান থানা-পুলিশের হাতে আটক হন তিনি। পরে তাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর গুলশান ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী নাইমুর রহমান হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *