শিরোনাম

বরিশালে দেড়শ টাকার তরমুজে সাড়ে ৬শ টাকা লাভ!

Views: 56

বরিশাল অফিস :: খেত থেকে বাজার পর্যন্ত আসতে একটা তরমুজে ৬ থেকে সাড়ে ৬শ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এই চিত্র বরিশালের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত। যে তরমুজ ৭ থেকে ৮শ টাকায় কিনে খাচ্ছে মানুষ, সেই তরমুজই ফড়িয়া দালালরা কৃষকের কাছ থেকে কিনছে মাত্র ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায়। দু-তিন হাত ঘুরে বাজার পর্যন্ত আসতে এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও ৬ থেকে সাড়ে ৬শ টাকা। মাঝের এই মোটা অঙ্ক চলে যাচ্ছে ওই ২-৩ জনের হাতে। যার খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। মৌসুমি এই ফলের বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারি কোনো দপ্তরের নজরদারি না থাকায় ঘটছে এমনটা। আড়তদাররাও এক্ষেত্রে প্রকাশ করেছেন অসহায়ত্ব। আড়ত থেকে ৩শ টাকা দরে বিক্রি করা তরমুজ মাত্র ১-২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে কী করে ৭-৮শ টাকা হয়ে যাচ্ছে সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই তাদের কাছেও।

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কৃষক মশিউর রহমান বাবুল এবার ৩০ একর (স্থানীয় হিসাবে প্রায় ১৯ কানি) জমিতে তরমুজের চাষ করেছেন। বিক্রির জন্য তরমুজ নিয়ে ঢাকায় যাওয়া বাবুলের সঙ্গে কথা হয় মোবাইল ফোনে। তিনি বলেন, ১৮০ টাকা পিস দরে বিক্রি করেছি তরমুজ। একেকটির ওজন ছিল ৫ থেকে ৬ কেজি। খেত থেকে সরাসরি বিক্রি করলে ১৪০-১৬০ টাকা পেতাম।

বরিশাল নগর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে বাকেরগঞ্জে ২৪ কানি (১৬০ শতাংশে ১ কানি) জমিতে তরমুজের চাষ করেছেন শফিকুর রহমান মুন্সি। দালাল-ফড়িয়াদের কাছে কিছু বিক্রিও করেছেন। শফিক মুন্সি অবশ্য পিস হিসাবে নয়, বেচেছেন খেত অনুযায়ী। তিনি বলেন, তরমুজের ওজন হয়েছিল ৫ থেকে ৬ কেজি। প্রতি কানি বেচেছি ৩ লাখ টাকা দরে। প্রতি পিস তরমুজের দাম পড়েছে ১৩০-১৩২ টাকা।

প্রায় একই দরে তরমুজ বিক্রি করা গলাচিপার চরবিশ্বাস ইউনিয়নের মোন্তাজ ব্যাপারী বলেন, আমার তরমুজের সাইজ কিছুটা বড় হয়েছিল। ফড়িয়ারা প্রতি পিসে ১৪৫ টাকা দিয়েছে।

দেশের তরমুজের চাহিদার ৬৮ ভাগের জোগান যায় বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে। যে কারণে মৌসুম এলে বরিশাল অঞ্চলের দিকেই চোখ থাকে সারা দেশের ফড়িয়া-দালালদের। বরিশালের প্রসিদ্ধ পাইকার দত্ত অ্যান্ড সন্সের মালিক গণেশ দত্ত বলেন, চাষিরা তরমুজ নিয়ে আমাদের আড়তে আসেন। তাদের ধরে দেওয়া দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি আমরা। এই বেচা-কেনায় খরচ বাদ দিয়ে আড়তের কমিশন থাকে। এ বছর অবশ্য কৃষকরাও বেশ বাড়িয়েছেন তরমুজের দাম। এ পর্যন্ত যত লট এসেছে তাতে সাড়ে ৫ থেকে ৬ কেজি ওজনের তরমুজ ৩০০-৩৫০ টাকা পিস দরে বিক্রি করেছি আমরা। আড়তে ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া তরমুজ খুচরা বাজারে গিয়ে ৭-৮শ টাকা হচ্ছে কী করে- জানতে চাইলে নিরুত্তর থাকেন গণেশ। শুধু বলেন, এটা খুচরা বিক্রেতারা বলতে পারবেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে দেখছি তরমুজের সিজন এলে সক্রিয় হয় একটি চক্র। এরা নিয়মিত নয়, সিজনাল ব্যবসা করে। বেশি লাভের আশায় এরাই বাড়িয়ে দেয় দাম।

বরিশাল নগরের আরেক ব্যবসায়ী বাজার রোডের নান্টু হাওলাদার বলেন, এই যে খেতে গিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে তরমুজ কিনে নিয়ে আসে, এইসব ফড়িয়া দালালরা কিন্তু স্থানীয় নয়। ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ সারা দেশ থেকেই এরা আসে। খেতে বসেই বিক্রি করতে পারে বলে কৃষকরাও দিয়ে দেন।

তরমুজ কেনাবেচায় দেশের সবচেয়ে বড় আড়তপট্টি ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার ব্যবসায়ী মিজান তালুকদার বলেন, শুধু মধ্যস্বত্বভোগীদের দোষ দিলেই হবে না। এবার কৃষকরাও খেত পর্যায়ে দাম বাড়িয়েছেন। তাছাড়া সব সাইজের তরমুজ তো ৭-৮শ টাকায় বিক্রি হয় না। ৮-৯ কেজি ওজনের ক্ষেত্রেই শুধু দামটা বেশি। আমাদের কাছে ফড়িয়া, দালাল এবং কৃষকরা এই সাইজের তরমুজ ৪-৫শ টাকার নিচে পিস বিক্রি করেন না। এরসঙ্গে আড়তের খরচ আর কাঁচামালের ড্যামারেজ ধরে সাড়ে ৫-৬শ টাকায় বিক্রি করতে হয় আমাদের। এখন আড়ত থেকে ৬শ টাকায় কিনে কি করে খুচরা বিক্রেতারা ৮শ টাকায় বিক্রি করছেন সেই উত্তর আমরা দিতে পারব না। তবে খুচরা বাজারে ছোট সাইজের তরমুজ ৩শ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে।

বরিশাল নগরের সিএন্ডবি রোড এলাকার খুচরা তরমুজ বিক্রেতা আল আমিন ব্যাপারী বলেন, আড়ত থেকে যদি আমাদের ৬-৭শ টাকায় কিনতে হয় তাহলে পচা কিংবা বাতিল বাদ দিয়ে ৮শ টাকার নিচে বিক্রি করলে লাভ তো দূরে থাক জমি বেচে ব্যবসা চালাতে হবে।

বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, মূল সমস্যা হচ্ছে ফড়িয়া-দালাল নামের মধ্যস্বত্বভোগী এবং হাতবদলের পাইকার। শুধু তরমুজ নয়, খেত থেকে বাজার পর্যন্ত আসতে সব পণ্যের দাম ২-৩ গুণ বেড়ে যায় এদের কারণে।

ভোক্তা নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বরিশালের সহকারী পরিচালক সুমি রানী মিত্র বলেন, গলদটা শুরু হয় খেত থেকেই। কৃষকরা তরমুজ বিক্রি করার ক্ষেত্রে কোনো রসিদ দেওয়া-নেওয়া করেন না। আর খুচরা বিক্রেতাদের হাতে থাকে পাইকার কিংবা আড়তদারদের দেওয়া রসিদ। ফলে ভেতরের গলদ ধরা মুশকিল হয়ে পড়ে। কৃষক সচেতন হলেই মূল্য নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারব আমরা।

 

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *