বরিশাল অফিস:: বরিশাল নগরীর উত্তর সাগরদী এলাকায় খলিফা মঞ্জিলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অবাক হবেন অনেকেই। কেননা বাড়ির দরজায় যখন কেউ মশারি টানিয়ে রাখে তখন অবাক হবারই কথা। মশার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে বাড়ির প্রবেশ পথের দরজায় টাঙিয়েছেন মশারি। দিন কিংবা রাত সব সময়ই মানুষকে জ্বালাতে হয় মশার কয়েল। এতে মশা না মরলেও কয়েলের ধোয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন সব শ্রেণি বয়সের মানুষ। বর্তমানে মশার উপদ্রবে দিশেহারা বরিশাল নগরবাসী।
মশা বাহিত নানা রোগের আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে তারা। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে এ ব্যাপারে এখুনি উদ্যোগ নেবার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, কোনোভাবে বাগে আনা যাচ্ছে না ছোট এ পতঙ্গের বিস্তার দিন কিংবা রাত এক মুহূর্ত মশার কয়েল না জ্বালিয়ে থাকতে পারছে না বরিশাল নগরবাসী। তবুও মশার প্রকোপে অতিষ্ঠ সবাই। এ যেন মশা মারতে কামান দাগিয়েও হচ্ছে না রেহাই।
৫৮ দশমিক এক পাঁচ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ নগরীর বাসিন্দাদের তাড়া করছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। খাল, নালা, নর্দমা জুরে মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু মশক নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উঠেছে গড়িমসির অভিযোগ। নগরবাসী বলছে, সিটি কর্পোরেশন থেকে যে ওষুধ দেয়া হচ্ছ তাতে মশা মরছেনা। বরং বিভিন্ন ড্রেন ও খালে থাকা তেলাপোকা বাড়িতে ও রাস্তায় এসে মারা যাচ্ছে।
নগরীর রূপতলী হাউজিং এলাকার বাসিন্দা আবুল বাশার বলেন, ছয়তলায় একটি ফ্লাটে স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকি। মশার উৎপাত এতই বেশি যে, সন্ধ্যার পর ছেলে মেয়েকে মশারির মধ্যে রাখতে হয়। মশার জ্বালায় বাসায় কোথাও একটানা বসে থাকা যায় না। মশার কামড়ে স্বাভাবিক কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু মশা মারতে করপোরেশনের লোকজন স্প্রে করে গেলেও তা কোনো কাজে দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, নগরীর অন্য এলাকার তুলনায় এটি নিম্নাঞ্চল। সারা বছরই এ ওয়ার্ডে পানি জমে থাকে। এরমধ্যে নতুন নতুন বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। এছাড়া রূপতলী হাউজিং এলাকার পাশেই বাস টার্মিনাল। সেখানে টায়ার ও পরিত্যক্ত টিউব, যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত অবস্থায় প্রায় পড়ে থাকে।
টার্মিনালের রাস্তার দুই পাশের ড্রেন ও নালায় অসংখ্য প্লাস্টিকের কাপ, পানির বোতল, কর্কশিটের বাক্স, ডাবের খোসা, ঠোঙা জমে আছে। এখানে প্রচুর মশা জন্মায়। নতুন বাজার কালী মন্দির গলির বাসিন্দা ফারজানা জানান, নতুন বাজার হলো মশার কারখানা। সন্ধ্যার পর বাইরে বের হলে মশা যেভাবে ঘিরে ধরে, মনে হয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। দিনেও মশা কামড়ায়। ২৪ ঘণ্টা কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। বাচ্চাদের মশারির মধ্যেই রাখতে হয়।
বান্দ রোড এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান জানান, আগে দেখতাম সন্ধ্যা হলে মশার উৎপাত শুরু হয়, এখন দিন রাত সমান তালে মশার যন্ত্রণা। তবে সন্ধ্যার পর তা চরমে পৌঁছে। সন্ধ্যার পর কয়েল ছাড়া ঘরে থাকা যায় না।
এ বিষয়ে বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি শাহ্ সাজেদা বলেন, নগরীর সবখানেই মশার উৎপাত। সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম চললেও মশা কমছে না। মশা নির্মূলে আগাম ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়েছে।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ৫৮ বর্গ কিলোমিটারের বরিশাল নগরীতে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। ৩০টি ওয়ার্ডে বিভক্ত এ সিটির মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন মাত্র ১০০ কর্মচারী। আধুনিক সরঞ্জাম বলতে রয়েছে ১০টি ফগার মেশিন। আর রয়েছে ৪৫টির মতো হস্তচালিত স্প্রে। তবে যারা এসব পরিচালনা করছেন, তাদের নেই কোনো দাপ্তরিক প্রশিক্ষণ। ফলে তারা জানেন না কোথায় কোন প্রজাতির মশা রয়েছে। কোন মশার জন্য কী ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। আর কীটনাশক প্রয়োগের মাত্রার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা কতটুকু।
কিন্তু মশার উপদ্রব বন্ধে সিটি করপোরেশন থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানান সংশ্লিষ্টরা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরিশাল সিটি করপোরেশনে মশক নিধনের জন্য কীটনাশক ক্রয় বাবদ প্রস্তাব করা হয় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বাবদ ৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের মশক নিধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস জানান, মশক নিধনে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রোগ্রাম নিয়েছি। প্রতিদিন প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি টিম মশার লার্ভা শনাক্তে কাজ করেন। লার্ভা শনাক্ত হলে সেখানে হ্যান্ড স্প্রে ব্যবহার করে লার্ভা ধ্বংস করা হয়।
এছাড়া বিকেলে ফগার মেশিন দিয়ে মশক নিধনে স্প্রে করা হয়। তবে যারা এসব কাজ করছে তারা প্রত্যেকে ২০/২৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তিনি আরও বলেন, এডিস মশার লার্ভা শনাক্তে বরিশালে কোনো ল্যাব নেই। যে কারণে মশার লার্ভা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। তবে মশার লার্ভা শনাক্তের জন্য বরিশাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে একজন কর্মকর্তা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তা দেওয়া হয়নি।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, মশার কামড় থেকে বাঁচাতে ঘরে সবাইকে মশারি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া বাড়ির আশপাশে যাতে মশার বংশবিস্তার লাভ করতে না পারে এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মশক নিধনে কাজ করতে হবে।