শিরোনাম

বাঁধ সংস্কারে বন উজাড় – ঝুঁকিতে উপকূলের মানুষ

Views: 49

মো: আল-আমিন, পটুয়াখালী : ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছাস ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে সমুদ্র উপকূলকে রক্ষায় পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চলছে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সবুজ বেস্টনি গড়ে তোলা এ প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকলেও হয়েছে তার উল্টোটা।

বাঁধ নির্মাণে ধ্বংস করা হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। কাজের মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। বাঁধে ব্যবহার করা হয়েছে বালু মিশ্রিত সংরক্ষিত বনের মাটি। উজাড় করা হয়েছে প্রায় শত একর বনভূমি। বনের জমিতে দিঘি কেটে বানানো হয়েছে মাছের ঘের। বন ধ্বংস বন্ধে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলেও কোনো সুফল আসেনি। উল্টো প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে মামলা, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।

জানা গেছে, পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ৪৮ নম্বর পোল্ডারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ উন্নয়নের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই। উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প, ফেজ-১ প্রকল্পের আওতায়, প্যাকেজ-২ এর কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা রয়েছে।
শুরুতে এ কাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না সিআইসিও (সিকো) শুরু করলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি। এরপর স্থানীয়
বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সাব ঠিকাদার নিয়োগ করেন। তারপরই শুরু নানা অনিয়মের অভিযোগ। উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ নির্মাণে স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা মাটির পরিবর্তে বালু ব্যবহার করেছে। এমনকি বালু মিশ্রিত মাটি আনা হয়েছে সংরক্ষিত বনের ভেতর থেকে। যার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে মানুষের জানমাল রক্ষাকবচ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বিশালাকৃতির হাজার হাজার গাছ উপড়ে বড় বড় দিঘি তৈরি করা হয়েছে। বনের মালিকানা দাবিতে এসব দিঘিতে স্থানীয় প্রভাবশালীরা মাছ চাষ করছেন। ফলে সমুদ্র বেষ্টিত উপকূলের সবুজ বেষ্টনী দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ভেস্তে গেছে সরকারের মূল পরিকল্পনা। এসব অনিয়মে জড়িত রয়েছেন পাউবো ও বনবিভাগের কর্তাব্যক্তিরা এমন দাবি ভুক্তভোগীদের।
বেড়িবাঁধের পাশের বসবাসকারীদের অভিযোগের শেষ নেই।

বনসংলগ্ন কুয়াকাটার মম্বিপাড়ার বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য দুলাল সিকদার জানান, বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে যে মাটি ব্যবহার করা হয়েছে এসব মাটি বালু মিশ্রিত। গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনের গাছ ভেকু দিয়ে উপড়ে ফেলে মাটি আনা হয়েছে। বন উজাড় করে মাটি এনে ব্যবহার করা হয়েছে বেড়িবাঁধে। এ বিষয় তারা বিভিন্ন সময় বন বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনকে অবহিত করলেও তারা দেখছি, দেখব বলে আশ্বস্ত করলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। তার অভিযোগ বন উজাড় করার পেছনে বন বিভাগের কর্মকর্তারাই দায়ী।

বনের উপকারভোগী মো. হেমায়েত ফকির বলেন, বাঁধ সংস্কার করতে গিয়ে শত শত একর বনভূমি উজাড় করা হয়েছে। বন বিভাগ শুধু কয়েকটি মামলা করেই তাদের দায়িত্ববোধ শেষ করেছে। স্থানীয় সাব ঠিকাদার আবু সালেহসহ প্রভাবশালী কয়েকজন মিলে বন ধ্বংস করে মাটি এনে বেড়িবাঁধে ব্যবহার করেছে। হাজার কোটি টাকার বনভূমি উজাড় করা হয়েছে দাবি তার। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করলে উল্টো তাদের নামে মামলা করা হয়েছে। হুমকি দেয়া হয়েছে জীবন নাশের।

কুয়াকাটা পৌরসভার প্যানেল মেয়র শহিদ দেওয়ান বলেন, সাব ঠিকাদাররা বেড়িবাঁধ সংস্কারে ব্যাপক অনিয়ম করেছে। মাটির চেয়ে বালুর ব্যবহার বেশি করা হয়েছে। রাতের আধাঁরে বাঁধের স্লোপ থেকে বালু উঠিয়ে বাঁধের মধ্যে দিয়ে উপরে শুধু মাটির প্রলেপ দেয়া হয়েছে। স্থানীয়রা এ কাজ বন্ধ করে দেন এবং পৌর মেয়রের কাছে অভিযোগ দেন। পরবর্তী সময়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর হস্তক্ষেপে আবার কাজ শুরু করা হয়।

এছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বন উজাড় করার কারণে ঝড় বন্যার সময় ঝুঁকি বেড়েছে। মাটির পরিবর্তে বাঁধে বেশির ভাগই বালু ব্যবহার করায় বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে তাদের শঙ্কা রয়েছে।

অভিযোগ অস্বীকার করে পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, জনবল সংকটের মধ্যেও তারা বন রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা দেয়া হয়েছে। প্রশাসনিক সহযোগিতা না পাওয়ায় বন রক্ষায় তারা কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেননি। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানোর পর তারা কয়েক দফা পরিদর্শন করে গেছেন।

পাউবো কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে বেশ কিছু অভিযোগ ছিল। সেগুলো সমাধান করেই কাজ চলমান রয়েছে। তবে বাঁধে ২৫ ভাগ বালু ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। বাঁধে বনের মাটি ব্যবহারের বিষয় তিনি জানান, বাঁধে মাটি কিনে ব্যবহার করা হয়েছে। সাব ঠিকাদাররা কোথা থেকে মাটি এনেছে এটা তাদের জানার কথা নয় বললেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বন রক্ষার জন্য বনবিভাগকে আরো সর্তক থাকতে হবে। তার কাছে এমন অভিযোগ এলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে কয়েকটি ড্যাম্প ট্রাক ও ভেকু জব্দ করা হয়েছে। বনের মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেয়া হয়েছে। তবে বনের জমির মালিকানার প্রশ্নে তিনি জানান, কিভাবে তারা বনের জমির মালিক হয়েছেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তবে সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরের কর্মকর্তা মামলাসহ নানামুখী উদ্যোগের কথা বললেও ইতোমধ্যে কুয়াকাটার গঙ্গামতি সংরক্ষিত বন, লেম্বুর বনসহ উপকূলের কয়েক শত বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। বন প্রেমীদের মতে হাজার কোটি টাকার বন ধ্বংস করা হয়েছে। এর দ্বায় কে নেবে এমন প্রশ্ন উপকার ভোগীদের।

উপকূলের রক্ষাকবচ খ্যাত সংরক্ষিত বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি বন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জোর দাবি স্থানীয়দের।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *