শিরোনাম

বাংলাদেশে সফল প্লাস্টিক সার্জারি ভুটানের তরুণীর

Views: 46

চন্দ্রদ্বীপ ডেস্ক : ভুটানের তরুণী কারমা দেমা (২৩)। ৮/১০ বছর আগে তার নাকে ক্যান্সার হয়েছিল। ভারতের বিখ্যাত টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে তিনি ভর্তি হন। সেখানে তার নাকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। পোস্ট রেডিয়েশনের কারণে তার নাকের ভিতরে পচন ধরে যায়। পরে বাম হাত থেকে মাংস ও বাম পাজরের হাড় নিয়ে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়। দুই বার অস্ত্রোপচার (প্লাস্টিক সার্জারি) করেও সুফল পাননি। এক পর্যায়ে অপারেশনের পর তার নাকের ভিতরে কিছু কিছু জায়গায় পচন ধরে। অর্থাৎ অপারেশন ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ নাক ফিরে পেলেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভুটান সরকার যৌথভাবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে থিম্পুতে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের মাধ্যমে একটি প্লাস্টিক সার্জারি ক্যাম্পের আয়োজন করেছিলেন। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ১৪ সদস্যের এই চিকিৎসক দলের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি বার্ন ইনস্টিটিউটগুলোর জাতীয় সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করছেন। সাত দিনব্যাপী এই ক্যাম্পে ১৬টি জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছিল। ওই ক্যাম্পে নাকের চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন কারমা দেমা।

প্লাস্টিক সার্জনরা তাকে দেখে বলেন, এখানে চিকিৎসা সেবা দেওয়া এই সময়ের মধ্যে সম্ভব না। দীর্ঘ সময় লাগবে। তবে আমাদের দেশে এটি সম্ভব। তখন ডা. সামন্ত লাল সেনকে অনুরোধ করে তারা। ওই দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও কথা বলেন। দেশে গিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলে জানানোর আশ্বাস দেন ডা. সামন্ত লাল সেন। বিদেশি নাগরিককে জাতীয় প্রতিষ্ঠানে এনে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু আইনি জটিলতা আছে। এরপর ভুটান ও বাংলাদেশ সরকার কারমার চিকিৎসা শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে করার বিষয়ে একমত হয়। গত ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি কারমার অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাঁর শরীরের ডান হাত থেকে মাংস ও ডান পাজরের হাড় নিয়ে নাক পুনর্গঠন করা হয়েছে। অস্ত্রোপচারে সময় লেগেছিল আট ঘণ্টা। ডা. সামন্ত লাল সেনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই অস্ত্রোপচারে নেতৃত্বে ছিলেন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাস। নাক সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন করতে আরও একবার ছোট অপারেশন করতে হবে। এ জন্য কারমাকে দুই মাস পরে আসতে বলা হয়েছে। নাকের বাকা অংশগুলো সোজা করে দেবে, নাক আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কেউ বুঝতে পারবে না, তার নাকে ক্যান্সার হয়েছিল। কিছু দিন টুকটাক সমস্যা হলেও পরবর্তীতে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন তিনি।

ভুটানি এই রোগীকে দেশে আনা থেকে চিকিৎসা দেওয়া-সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডা. সামন্ত লাল সেন। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পরদিন মন্ত্রণালয়ের কাজ সেরে দুপুরে তিনি শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছিলেন কারমাকে দেখতে। সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এটি এই জন্য বড় ঘটনা যে বিদেশি রোগী আমাদের দেশে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। দুই দেশের সরকার এই চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত। আমাদের দেশের চিকিৎসাসেবা নিশ্চয়ই উন্নত হয়েছে।’

কারমা দেমা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তারদের একটি বোর্ড গঠন করা হয়। অপারেশনে নেতৃত্ব দেন ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাস। তার পুরো চিকিৎসা সেবার চিফ কোর্ডিনেটর ছিলেন ডা. সামন্ত লাল সেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রাখা হয় এই বোর্ডে। তান নাম অধ্যাপক ডা. অনিল রঞ্জন। বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অপারেশন হয়েছে। সম্প্রতি ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুক চার দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। তিনি ইনস্টিটিউটে চিকিত্সাধীন কারমা দেমাকে সুস্থ দেখে অভিভূত হন। রাজা বাংলাদেশি চিকিৎসক দলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, যেটা আশা করতে পারিনি, সেটা আপনারা করে দেখিয়েছেন। আপনাদের ধন্যবাদ। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মডেলে ভুটানে একটি হাসপাতাল করার জন্য অনুরোধ করেন রাজা। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন হাসপাতাল করার জন্য সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন।

গতকাল কারমা দেমার ছাড়পত্র হাতে নেন তার ভাই। এ সময় ভাই-বোনের মুখে ছিল হাসি। অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কারমা দেমা বলেন, এভাবে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাব, কখনো কল্পনাই করিনি।

কারমা দেমার মতো অনেক জটিল রোগীর অপারেশন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বিনামূল্যে করা হয়েছে। এই অপারেশন করতে বিদেশে দুই কোটি টাকার উপরে খরচ হয়। দেশেও ব্যয়বহুল এর চিকিত্সা। বেসরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা অনেক মধ্যবিত্তের পক্ষেই সম্ভব হবে না। অথচ এখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। কারমা দেমার আগে আরেকটি জটিল রোগীর এখানে সফল অপারেশন হয়েছে। তিনি হলেন সাতক্ষীরার এনামুল হক। ৩৭ বছর যাবত্ তার নাকে-মুখে গর্ত হয়ে বিকৃত চেহারা তৈরি হয়। নাক-মুখ দিয়ে পোকা বের হতো। এর আগে তার ১০ বার অপারেশন হয়েছে। কোন সুফল পাননি। বিএসএমএমইউয়ে ভর্তি হলে, তারা পোকা মারে, কিন্তু অপারেশন করতে পারেনি। তার এক ছেলে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। বিএসএমএমইউ যখন বললো, অপারেশন করা সম্ভব না, তখন আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ করেন ওই রোগীর ছেলে। তবে রোগীর কেস স্টাডি দেখে তারাও বলে দেয়, সম্ভব না। তবে একটি দেশ বলেছিল, সম্ভব হতে পারে। অপারেশনের জন্য খরচ হবে বাংলাদেশি দুই কোটি টাকা। তবে তার পরিবার এতো টাকা কোথায় পাবে? পরিবারের পক্ষ থেকে অর্থ সহযোগিতার জন্য ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছে যান। রোগীর সব কিছু দেখে ডা. সামন্ত লাল সেন তাদের বলেন, রোগীকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করতে। পরে তিনি ভর্তি হলে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সফল অপারেশনের মাধ্যমে ওই রোগীকে সুস্থ করে তোলা হয়।

জোড়া শিশু তোফা-তহুরাও সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে। অথচ তাদের সিঙ্গাপুর ফেরত পাঠিয়েছিল। এমন অনেক উদাহরণই আছে। বর্তমান সরকার চিকিৎসা খাতে ব্যাপক অবদান রেখেছে। প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়। ৯৮ ভাগেরই প্লাস্টিক সার্জারি করতে হয়। এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা দেশের মধ্যবিত্তের পক্ষেও সম্ভব না। অথচ এখানে বিনামূল্যে হচ্ছে। এটা দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে বড় সফলতা। এতো বড় ইনস্টিটিউট বিশ্বের কোথাও নেই।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কারণে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা এদেশের সকল শ্রেণীর মানুষ বিনামূল্যে পাচ্ছে। কারমা দেমার চিকিৎসা সফল হওয়ায় তিনি মেডিক্যাল টিমকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *