সোমালিয়ার জলদস্যুরা ছিলো হিংস্র প্রকৃতির
বরিশাল অফিস :: নিজ গ্রামে ফিরেছে সোমালিয়ান জলদস্যুদের জিম্মি থেকে মুক্তি পাওয়া বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি ইউপির পশ্চিম উমারের পাড় গ্রামের বাসিন্দা ও এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের নাবিক মো. আলী হোসেন। বৃহস্পতিবার সকালে একাই তিনি বাড়ী ফেরেন। বরিশালের বানারীপাড়ার উপজেলার খেয়াঘাট এলাকায় তাকে বরণ করেন বাবা, স্ত্রী, চাচা ও বন্ধু। পরে তারা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়।
সেখানে নাবিক আলী হোসেন জানান, সোমালিয়ান জলদস্যুদের ছিনতাই করার একদিন পর নেভির একটি জাহাজ আসছিলো “এটাকিং পজিশন নিয়ে” আমাদের রেসকিউ করতে। ওই দিন আমাদের ভয়াবহ অবস্থা ছিলো। তখন কাউন্ট ডাউন করে ফায়ারিংয়ের জন্য প্রিপারেশন নিয়েছিলো। তখন জলদস্যুরা হুমকি দিয়ে বলেছিলো লিভ দ্যা ভ্যাসেল, আদার ওয়াইজ উই উইল ফায়ার। ওরা যখন কাউন্ট ডাউন করতে ছিলো ‘ওয়ান থেকে টেন। সবাই তখন ফ্লোরের মধ্যে শুয়ে গেছিলো। ওরা তখন ওপেন ফায়ার করছিলো, জাহাজের দিকে না “খোলা আকাশের দিকে”। তখন আমাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন তখন ওদের চলে যেতে বলেছিলো। তখন আমাদের অনেক হুমকি ধামকি দিয়েছিলো। ওরা তখন বলছিলো আমাদের জীবন বাঁচলে তোদের টা বাঁচবে। তখন সবাই ভয় পেয়েছিলাম ক্রস ফায়ারে মারা যাওয়ার। কিংবা গুলি লেগে আহত হলেও সমুদ্রে তো কোন চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা ছিলো না। তাই সকলের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রথম এক সপ্তাহ আমরা ভয়ংকর আতংকের মধ্যে ছিলাম।
এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের অয়েলার পদের নাবিক আলী হোসেন আরো বলেন, নেভির কোন বোট এলে ওরা সেইভাবে প্রিপারেশন নিতো। ওদের কাছে অনেক ভারী অস্ত্র ছিলো। যেগুলো আমরা মুভিতে দেখেছি। আমরা সব অস্ত্রের নামও জানি না। একে ৪৭, মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার অনেক ভারী অস্ত্র ছিলো। যেগুলার সামনে আমাদের সাধারন মানুষের করার কিছু ছিলো না। তাই আমরা ওদের কমান্ড ফলো করেছি। ওরা একদম হিংস্র প্রকৃতির। সভ্যতা ওদের কাছে পৌঁছেনি। ওদের খাবার-দাবার চাল চলন এখনো হিংস্র প্রকৃতির। ওদের সাথে সাধারন মানুষের সার্ভাইভ করা কঠিন।
মুক্ত হওয়ার খবরটা ওদের কাছ থেকে শুনিনি। তবে ওদের আচার-আচরনে ঈদের দুইদিন আগে বুঝতে পেরেছি আমরা মুক্তি পাচ্ছি।
আমাদের কোম্পানী সরকারের মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগ করতে পেরেছে এই কারনে আমাদের সাথে কোন টর্চার করেনি। ওরা বলেছে “আমাদের কোম্পানী অনেক ভাল। তারা দ্রুত যোগাযোগ করেছে।
মুক্ত হওয়ার আগে একটু সমস্যা হয়েছিলো জানিয়ে আলী হোসেন বলেন, ঈদের সময় নামাজের একটি ছবি লিক হয়েছিলো। ওদের একজন ট্রান্সলেটার বিষয়টি দেখে ঈদের পরেরদিন সবাইকে ডেকে ব্রীজে নিয়ে গেছে। তখন তারা বলেছে এই ছবি কে লিক করেছে “কাম টু ফরওয়ার্ড”। তাকে সামনে আসতে বলছে। ইফ সেইভ মাই স্কিন, আই উইল সেইভ ইউ। আমার চামড়া বাঁচলে তোমাদের চামড়া বাঁচবে। ওই দিনটাও আমাদের জন্য ভয়াবহ ছিলো। কিন্তু কোম্পানীর সাথে মীমাংসার পর্যায় চলে যাওয়ায় আমাদের কোন সমস্যা হয়নি।
মা-বাবার কাছে ফিরে আসতে পেরে খুশি আলী হোসেন বলেন, এটা একটা অনাকাঙ্খিত বিষয় ছিলো। এখান থেকে ফিরে আসবো ভাবি নাই। সবাইকে কাছ আসতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ খুশি। নিজ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছানোর পর প্রতিবেশিরাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধরা ছুটে আসেন। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করেন আলী হোসেন।
সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ার ঘটনার বর্ননায় আলী হোসেন জানান, ১২ মার্চ আমার ডিউটি অফ ছিল, আরকি আমার অফ ডে। ঘটনার সময় আমি ঘুমাচ্ছিলাম। তখন ইমারজেন্সি এলার্ম বেজে ওঠে। আর আমি ঘুম থেকে উঠে ব্রিজের দিক যেতে যেতে মাইকে শুনছিলাম সন্দেহভাজন একটি বোট আমাদের জাহাজের কাছাকাছি আসার কথা।
আমরা সবাই ব্রিজে গিয়ে দেখতে পাই একটি বোট জাহাজের বাম দিক থেকে আসছে। তবে সেখান থেকে তারা জাহাজে উঠতে না পেরে পেছন থেকে ঘুরে ডান দিকে আসে। পরে লেডার আর জ্যাক টাইপের কিছুর সাহায্যে জাহাজে উঠে যায় তারা।
যেটুকু শুনেছি এক দেড়মাস আগে ইরানিয়ান একটি ফিশিং বোট ওরা জিম্মি করে আর সেটা নিয়ে মধ্যসাগরে ওরা ঘুরছিলো বড় জাহাজ আটকানোর জন্য। স্পিডবোট দিয়ে তো অতদূর যাওয়া সম্ভব না। যা হোক আমাদের ধরার পর ওদের (ইরানি জাহাজ) রিলিজ করে দেয়।
তিনি বলেন, এরআগেই আমাদের ক্যাপ্টেন সবার সাথে যোগাযোগ করছিল, আর ইঞ্জিন রুমের একজন ছাড়া আমাদের সবাইকে জাহাজের গোপন রুমে নিয়ে রাখে চিফ অফিসার। তবে ওরা জাহাজে উঠেই আমাদের ক্যাপ্টেন আর চিফ অফিসারকে আটকে ফেলায় বাধ্য হয়ে আমাদের স্যারেন্ডার করতে হয়। তখন হাত উপরে দিয়ে অনেকটা মুরগির মতো করে সবাইকে ব্রিজে যেতে হয়। হাটু গেড়ে সবাই সেখান অবস্থান নিয়ে দেখি দস্যুদের সবার হাতে অস্ত্র। সেগুলো না চিনলেও দেখা মুভির সাথে মিলিয়ে মনে হয়েছে একে ৪৭ হবে।
তিনি বলেন, প্রথম দফায় ওরা চারজন থাকলেও পরে আরও এসে ১৩-১৪ জন হয়। পরে একটু রিলিজ দিলে সবাই যে যার মতো করে বাসায় ও অফিসে যোগাযোগ করে। এরপর ওরা ফোন নিয়ে নেয় এবং আমাদের সবাইকে ব্রিজেই থাকতে হয়েছে।
পোর্ট থেকে বের হলেই জাহাজে এক থেকে দেড়মাসের খাবার সবার জন্য নিয়ে নেয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, রমজান মাস হওয়ায় ক্যাপ্টেন স্যারই পর্যাপ্ত বাজার করেছিলো। তারওপর সে নিজ থেকে উদ্যোগ নিয়ে কোম্পানিকে বলে বেশি পানি নিয়ে নিয়েছিল। পানি না থাকলে আমাদের দুঃখ ছিল, এজন্য ক্যাপ্টেন স্যারকে ধন্যবাদ। তবে শেষ দিক ছাড়া খাবারের কারনে তেমনভাবে কষ্ট হয়নি।
তিনি বলেন, জাহাজে ফ্রেশ ওয়াটার না থাকলে আমরা থাকতে পারতাম না। গ্যাপ দিয়ে হলেও ওরা ফ্রেশ ওয়াটারের ব্যবস্থা করেছে।
প্রথমে চাচ্ছিলাম না যে পরিবারকে জানাবো, তবে কি হবে সেই চিন্তায় বড়ভাইকে জানিয়ে বলেছিলাম নেটওয়ার্ক সমস্যার দোহাই দিয়ে যেন তিনি বাসায় সবাইকে বুঝিয়ে রাখে। পরে পরিস্থিতি খারাপ দেখে, জীবনে আর কথা বলতে পারবো কিনা এমন শঙ্কায় সবার সাথে কথা বলেছি। আর যখনই কথা হয়েছি তখনই ভাল কিছু বলার চেষ্টা করেছি বাসায়, যাতে তারা উদ্বিগ্ন না হয়।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে তো ব্রিজ থেকে নামারই সুযোগ দিত না, আর সেখানে মাত্র একটা ওয়াশরুম ছিল সেটিও ওরা ভেঙ্গে ফেলেছিল। ফলে খুবই কষ্ট হয়েছিল।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে ওদের আসার কারণই আমরা বুঝতে পারছিলাম না। তবে মুসলিম দেখে কিছুটা শিথিল আচরণ দেখিয়েছে মাঝে মাঝে। আমরাও চেষ্টা করেছি ওরা যাতে অ্যাগ্রেসিভ না হয় সেভাবে চলার।
তিনি বলেন, প্রথমে ১৩ জন থাকলেও আড়াই দিন পর সোমালিয়া পৌছালে জাহাজে ৩০-৩৫ জন ওঠে। আর শেষ দিকে ৬০-৬৫ জন হয়ে যায়। এরপর ওরা আমাদের সকল খাবার খেয়ে শেষ করে ফেলে।
তিনি বলেন, মুক্তির দিন বেলা ১১ টার দিকে সবাইকে একটি জায়গায় সারিবদ্ধভাবে দাড়াতে বলে। এরপর ছোট একটি বিমান থেকে তিনটি বস্তা ফেলতে দেখি, তবে তার মধ্যে কি ছিল অনুমান করতে পারিনি। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর জানতে পারি ডলার ছিল বস্তায়।
দস্যু আক্রমনের সাথে সাথে আমার থেকেও পরিবারের কথা বেশি মাথায় এসেছিল। বাবা- মা, স্ত্রীর কি হবে এটা ভেবেই কষ্ট লেগেছে বেশি। ওইসময় গুলো মৃত্যুর চেয়েও খারাপ মনে হয়েছিল। মৃত্যু হয়তো হঠাৎ করেই হয়ে যায়, কিন্তু এখান থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব তা কেউ বুঝতে ছিলাম না।
সন্তান বাড়ি আসার সাথে সাথে তাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন “আজ আমার ঈদের দিন। তাই ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করেছেন তিনি।
দেশী মুরগী, শোল ও চিংড়ি মাছ, শাক রান্না করার করেছেন জানিয়ে আলীর মা কোম্পানী ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।গত ৯ জুলাই বিয়ে করা স্ত্রী ইয়ামনি ইসলামকে বাড়ী রেখে গত ২৫ নভেম্বর বাড়ি থেকে যান আলী। গত ২৫ নভেম্বর জাহাজে রওনা দেয় সে।
আলীর নববধূ ইয়ামনি ইসলাম বলেন, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি। আল্লাহর উপর ভরসা ছিলো তাকে ফিরিয়ে দেবেন। রমজান শেষে আমাদের ঈদ হয়নি। আজ ঈদ আনন্দ।ইয়ামনি ইসলাম দাবি এরপরে যেন এ ধরনের কোন ঘটনার পূনরাবৃত্তি না হয় সেই ধরনের ব্যবস্থা করার। ছেলেকে ফিরে পেয়ে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন আলীর বাবা ইমাম হোসেন।