দেশের চলমান অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, সরকারকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হয়েছে। রোববার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাতটায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক জোরালো ভাষণে তিনি এসব তথ্য তুলে ধরেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে বিশ্বব্যাপী এক মহাপরিকল্পনা প্রতি মুহূর্তে কার্যকর রয়েছে। তাদের প্রচেষ্টা হচ্ছে দেশব্যাপী বিভেদ ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তারা আমাদের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে তাদের লক্ষ্য। আমাদেরকে অবশ্যই এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।”
বিশ্বব্যাপী ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত
ড. ইউনূস আরও বলেন, “বহির্বিশ্ব থেকে বিপুল অর্থ দিয়ে দেশীয় কিছু দোসরদের কাজে লাগিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার প্রচেষ্টা চলছে। যারা পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে, তারা এখন সেই অর্থ ব্যবহার করে দেশে ফেরার চেষ্টা করছে। এদের উদ্দেশ্য আমাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করা ও দেশকে আবারও দুর্নীতির অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। তাদের সফলতা মানেই জাতির মৃত্যু, আমাদের মুক্তির স্বপ্নের অবসান।”
অর্থনৈতিক উন্নয়নের অঙ্গীকার
ভাষণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, সকল প্রকার সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা আপনাদেরকে একটি শক্তিশালী ও মজবুত অর্থনীতি উপহার দেবো। আগামীতে নাগরিক অধিকার, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি আসবে।”
ড. ইউনূস বলেন, “পতিত সরকারের আমলে প্রতি বছর দেশ থেকে ১২-১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। আমরা সেই পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিচ্ছি।”
বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র থেকে সাবধান থাকার আহ্বান
ড. ইউনূস দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনারা জানেন, পরাজিত শক্তি নানা চেহারায় এসে আপনাদের প্রিয়পাত্র হবার চেষ্টা করছে। এদের ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে ও দেশকে মুক্ত রাখুন। আমাদের ঐক্যই হবে এদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মূল অস্ত্র। প্রতিটি নাগরিককে আহ্বান জানাচ্ছি—আপনারা দৃঢ় থাকুন, দেশ ও জাতির স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকুন।”
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কথা
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আমার সাম্প্রতিক জাতিসংঘ সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, ইতালি, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তারা আমাদের বর্তমান সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গেও আমাদের আলোচনা হয়েছে এবং সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছি।”
দেশের জন্য সতর্ক বার্তা
ড. ইউনূস আরও বলেন, “প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা যাই হোক না কেন, আমাদের লক্ষ্য অটুট রাখতে হবে। আমরা আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তিকে কোনোভাবে হারাতে দেব না। দেশের জনগণকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি—আপনারা সব সময় সতর্ক থাকুন। এবার যে মুক্তি আমরা অর্জন করেছি তা আমাদের কাছ থেকে কেউ যেন ছিনিয়ে নিতে না পারে।”
সাম্প্রতিক নাশকতা মোকাবিলায় প্রস্তুতি
তিনি আরও বলেন, “পরাজিত শক্তি তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা প্রস্তুত আছি তাদের প্রতিটি ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করতে। এবার যেভাবে আমরা দেশের উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছি, তা ধরে রাখতে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।”
বক্তৃতার প্রতিক্রিয়া
ড. ইউনূসের ভাষণটি দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি বর্তমান সরকারের অবস্থানকে আরও মজবুত করবে এবং ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করবে। এছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এই ভাষণ একটি নতুন দিশা প্রদান করবে বলে মনে করা হচ্ছে।