বরিশাল অফিস :: ভারতে রপ্তানি করার সিদ্ধান্তের কয়েকদিন আগে থেকেই বাজারে ইলিশের সংকট স্পষ্ট ছিলো। সরকারি ঘোষণার পর পরই বাজার থেকে উধাও হয়েছে ইলিশ। যা একটু পাওয়া যাচ্ছে তা বেশিরভাগই এলসি থেকে বাদ পড়া ঝাটকা।
ক্রেতারা বলছেন, ভারতে যে রপ্তানি হবে এটা জানতো ব্যবসায়ীরা। তাই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তারা পর্যাপ্ত ইলিশ সংরক্ষণ করতে শুরু করে। যে কারণে বাজারে ইলিশের দাম প্রথম থেকেই বাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। এটা দেশ ও মানুষের সাথে এক ধরনের প্রতারণা। ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়ে সরকারিভাবে ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইলিশ কিনতে ব্যর্থ একাধিক ক্রেতা। অপরদিকে সাগর ও নদীতে দাদন নিয়ে মাছ ধরেন জেলেরা। তাই মহাজনের কাছে বন্দী তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা। তারা বলেন, সুদখোর ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই। থাকলে তারাই আগে প্রতিবাদ জানাতো এই সিদ্ধান্তের। উল্টো এই ব্যবসায়ীরাই সরকারকে ইলিশ রপ্তানি করতে বাধ্য করেছে বলে জানান একাধিক জেলে নেতা।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গেল এক দশকে ইলিশ উৎপাদনের হার ছিল আকর্ষণীয়।
বিশেষ করে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ টনের বেশি। হিসাব অনুযায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার টন ও সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। অর্থাৎ শেষ পাঁচ বছরে গড়ে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে আড়াই শতাংশের বেশি।
যদিও জেলেদের দাবি, এ হিসাব সম্পূর্ণ বানোয়াট। বরং গত পাঁচ বছর ধরে মাছের উৎপাদন কমে আসছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা চলমান সময়ে ভারতের জেলেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত থাকে। যা বৈষম্য সৃষ্টি করছে এবং বাংলাদেশের জেলেরা মাছ কম পাচ্ছে।
এ নিয়ে সহমত বাংলাদেশের মৎস গবেষকরাও। তবে তা কখনো গুরুত্ব পায়নি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার কাছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে ইলিশ সুরক্ষায় তিন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এর মধ্যে অক্টোবরে ২২ দিন। এ সময় মা মাছের ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর বাচ্চা হলে তার সুরক্ষায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল দুই মাস নিষেধাজ্ঞা থাকে। মাছের বৃদ্ধির জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই আবার একদফায় সাগরে নিষেধাজ্ঞা চলমান থাকে।
বাংলাদেশ মাৎস্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক আনিছুর রহমান গতবছর এ প্রসঙ্গে চন্দ্রদ্বীপ নিউজ২৪.কমকে বলেছেন, এখন আমরা যে সাফল্য পাচ্ছি, তা এই নিষেধাজ্ঞার ফল। নিষেধাজ্ঞার সময় পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই দাবী করে তিনি বলেন, তবে এখানে একটা সমস্যা আছে। আমাদের এখানে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা থাকে কিন্তু ভারতে নিষেধাজ্ঞা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত। ১৫ জুন শুরু হয় তাদের মাছ ধরা।’ এই জায়গায় দুইটি দেশের সমন্বয় প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞায় সাফল্য আসতে দেখে ভারতেও মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি চালু করা হয় ২০১৮ সাল থেকে। তবে এর আগে ভারতে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিলোনা। ফলে বাংলাদেশের জেলেদের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু নীতির কারণে জেলেদের স্বার্থে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে জানান বরগুনা ও পাথরঘাটার জেলেদের কয়েকজন। এ অঞ্চলের এমবি ফরাজী ট্রলারের মালিক দুলাল ফরাজি বলেন, বরগুনার তালতলী উপজেলার নিবন্ধিত ৫ হাজার ২০০ জন জেলে রয়েছে। ট্রলারের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। প্রতিটি ট্রলারে গড়ে ২০ জন জেলে ও শ্রমিক কাজ করে। প্রতিজন শ্রমিকের জন্য মাথাপিছু দাদন নেয়া হয়েছে। যে কারণে জেলেরা চাইলেও মহাজনের বাইরে যেতে পারেন না। কিন্তু এই মহাজনরা চাইলেই দেশের প্রতিটি বাজারে ইলিশ বিক্রি করতে পারেন বলে জানান তিনি।
যদিও চলতি বছর এ অঞ্চলের বেশিরভাগ ইলিশ বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুরের ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়েছেন বলে জানান বরগুনার আড়ৎদার বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স এর স্বত্বাধিকারী।
এদিকে বরিশালের সবচেয়ে বড় মাছের আড়ৎ পোর্ট রোড বাজারে মঙ্গলবার( ২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে কয়েক ডালা ২৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হতে দেখা যায়। যার দাম ছিলো (২০০-২৫০ গ্রাম) ৫৫০ টাকা কেজি। ৪শ থেকে ৬শ গ্রাম এর কেজি ১১শ টাকা এবং এলসি থেকে বাদ পড়া ৯শ থেকে ১১শ গ্রাম ইলিশ ১৫শ ও ১৭শ টাকা কেজি। দু’সপ্তাহ আগেও বাজারে একই দর ছিলো। তবে তখন বরিশালের বাজারে কিছুটা হলেও সাগরের ইলিশ পাওয়া গেছে। এখন বাজারের এই ইলিশ সবটাই নদীর বলে দাবী বিক্রেতাদের।
ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর, অঞ্জন দাস সহ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, বরিশালের মোকামে আগে হাজার টন ইলিশ আসতো। পদ্মা ও পায়রা সেতু হওয়ার পর থেকেই তা কমে গেছে। বর্তমানে পোর্ট রোড ইলিশ পাড়ায় সর্বোচ্চ ১০০ টন ইলিশ আসে। আর আজ মঙ্গলবার সকালে এলসি হয়েছে ৬০ টন মাত্র। যা বেশিরভাগ নদীর ইলিশ। তাদের ইলিশের বড় ক্রেতাও বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বলে জানান তারা।
বরিশালের মোকামে আড্ডারত জেলেদের কয়েকজন বলেন, আমাদের তুলনায় ভারতের জেলেরা সবসময় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। তারা মাছও বেশি ধরছে এবং তাদের ধরা ইলিশ বেশিরভাগই বড় বড় সাইজের। তারপরও লোক সংখ্যাগত কারণে ভারতের জন্য পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু আমাদেরও নিজ দেশের চাহিদা আগে মেটানো উচিত বলে জানান বরিশালের জেলে নেতা খোরশেদ আলম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাগরে যখন ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলে তখন আরও এক মাস ইলিশ ধরা বহাল থাকে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের জেলেদের। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনছে বলে মনে করেন তিনি। জেলেরা কেন সরাসরি বাজারে ইলিশ বিক্রি করছেন না প্রশ্নের উত্তরে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তারা। বলেন, আমরা তো দাদন নিয়ে তবে চলছি। মহাজনের কাছে আমাদের আপাদমস্তক ভাড়া দেওয়া। নিজস্ব ট্রলার যার আছে সে চাইলে বাজারে সরাসরি মাছ নিতে পারেন। আর আড়ৎদার ইচ্ছে করলে কোনো মাছই দেশের বাইরে যেতে পারেনা।
জানা যায়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মহাজন বা আড়ৎদার জেলেদের চড়া সুদে ঋণ দিচ্ছেন। যে কারণে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়ার পরও ঋণ পরিশোধ হয় না তাদের। এ নিয়েও রয়েছে একাধিক অভিযোগ। পটুয়াখালী ফিশিং বোট মালিক সমিতি, বরগুনা ফিশিং বোট মালিক সমিতির নেতাদের ভাষ্য, সরকারী উদ্যোগে ঋণমুক্ত করে সরাসরি বাজারে মাছ বিক্রির সুযোগ করে দিতে হবে। তাহলে দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে পর্যাপ্ত ইলিশ রপ্তানি সম্ভব হবে বলে।