বরিশাল অফিস :: মেঘনা পাড়ি দেওয়ার ব্যস্ত নৌপথ ভোলার ইলিশা-লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরী ঘাট। এ রুটে যাতায়াতকারী মানুষের তুলনায় নিরাপদ জলযান অপ্রতুল। বিষয়টিকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে একদল অসাধু ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা। মিলেমিশে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট, চালাচ্ছেন রমরমা বাণিজ্য। মেতেছেন মানুষের জীবন নিয়ে কমিশনের খেলায়। বর্ষা মৌসুমে উত্তাল এ নদীতে অবাধে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী পারাপার করছে ছোট ছোট ট্রলার-স্পিডবোট। দেখেও না দেখার ভান করছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। বিনিময়ে নিয়মিত তাদের পকেটে পৌঁছে যায় মাসোহারা। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে যাত্রীর চাপ তৈরি হওয়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা সত্ত্বেও বাড়ে ছোট ছোট ট্রলারের দৌরাত্ম্য।
ইলিশা-মজু চৌধুরী ঘাট রুটে চারটি সি-ট্রাক চালায় বিআইডব্লিউটিসি। এগুলোর ধারণ ক্ষমতা এক হাজার (প্রতিটি ২৫০ করে) জন। পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন দুটি লঞ্চ চলে। এগুলোর যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৯০০ জন। সারা বছর এসব বৈধ নৌযান দিয়ে যে পরিমাণ যাত্রী পারাপার করা হয়, চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ। ঈদসহ বিভিন্ন ছুটিতে বাড়তি ট্রিপও দেওয়া হয়। কিন্তু নৌযান না বাড়ানোর সংকট কাটে না। এতে ঈদের ছুটিতে কোনো কোনো দিন ২০ হাজার যাত্রীও পারাপার হন, যাদের অধিকাংশকেই বাধ্য করা হয় ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে যাতায়াত করতে। ছোট ট্রলারগুলোর যাত্রী পারাপারের অনুমোদন নেই, রাখা হয় না নদীর মাঝে বিপদে পড়লে উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থাও।
এ ছাড়া ১৫ অক্টোবরের পর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ছোট লঞ্চ চলায় খুব একটা সংকট হয় না। তখন সিডিউলের মারপ্যাঁচে ফেলে যাত্রীদের বাধ্য করা হয় স্পিডবোটে যাতায়াতে। এগুলোর অনুমোদন না থাকলেও চলে নির্ঝঞ্ঝাট।
অবৈধ নৌযান চলাচল ঠেকাতে ঘাট এলাকায় মাঝেমধ্যে নামকাওয়াস্তে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন। আদালতের নেতৃত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট আসেন অফিসের সময় ধরে সকাল ১০টার পরে। আর ট্রলার-স্পিডবোটগুলো দিনের সবচেয়ে বড় ট্রিপগুলো দেয় ওই সময়ের আগেই।
নেপথ্যে কারবারিরাযাত্রী ও ঘাট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সিন্ডিকেট সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। অবৈধ নৌযানের নির্বিঘ্ন চলাচল দেখভাল করেন ছয়জন। তারা হলেন– ইলিশা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য বশির মেম্বার, মো. মনির, মজু চৌধুরী ঘাটের ধানু, লিটন ও শিমুল বিশ্বাস। এই কারবারিরা সবাই ঘাট ইজারাদারের অনুসারী ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ও বিআইডব্লিউটিএর স্থানীয় কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে এই সিন্ডিকেট। তারা নিয়মিত কমিশন নিয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি উপেক্ষা করে অবৈধ যানগুলো চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়।
এজন্য স্থানীয় নৌ থানা ও পুলিশকে ‘মাসিক কিস্তি’ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ঘাটে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ট্রলার প্রতি একশ থেকে দুইশ টাকা করে (প্রতি সদস্য) মাসোহারা দেওয়া হয়। যা থানার মাসিক কিস্তির বাইরে। বিআইডব্লিউটিএর তিন কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন, রকিব হাসান ও মো. আলীকে প্রতি ট্রলার বাবদ পাঁচশ টাকা করে দিতে হয়। তাদের ম্যানেজ করার খরচ বাদে যা থাকে সেখান থেকে ঘাট ইজারাদার পান এক-তৃতীয়াংশ। অবশিষ্ট টাকা ভোগ করতে পারেন ট্রলার পরিচালনাকারীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রলার মালিক জানান, ঈদ করার জন্য নৌ থানায় ২০ হাজার এবং পুলিশ ফাঁড়িতে খাসি কিনে দিয়েছেন তিনি।
তবে ট্রলার থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক সুপারভাইজার রকিব হাসান ও মো. আলী। ভোলা পূর্ব ইলিশা নৌ থানার ওসি বিদ্যুৎ কুমার বড়ুয়াও টাকা নেওয়া এবং অবৈধ ট্রলার মালিকদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। বশির মেম্বার জানান, ঈদের সময় দু’একটা ট্রলার চলেছে। এগুলো ইলিশা ঘাটের না। লক্ষ্মীপুর থেকে এসে যাত্রী নিয়ে যায়।
ইলিশা থেকে মজু চৌধুরী ঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে যাত্রীদের গুনতে হয় ২০০ টাকা। ট্রলার ও স্পিডবোটে নেওয়া হয় ৩০০ টাকা করে। ঈদের ছুটিতে যাত্রীর চাপ বাড়ায় ৩০ থেকে ৩৫ জনের ধারণ ক্ষমতার ট্রলারগুলো গাদাগাদি করে ১০০ থেকে ৩০০ মানুষ পরিবহন করে। ঘাট-সংশ্লিষ্ট কর্মী, নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাকর্মীদের মাধ্যমে এসব যাত্রীকে জিম্মি করা হয়। আদায় করা হয় বাড়তি ভাড়াও। ম্যানেজের খরচ বাদ দিয়ে প্রতি ট্রিপে তাদের টেকে হয় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা।
রফিজুল হক, সিরাজুল হক, হনুফা খাতুনসহ কয়েক যাত্রী বলেন, চাহিদার ভিত্তিতে নৌযান না বাড়িয়ে যাত্রীদের ট্রলার মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। আর এই কারবারিরা মানুষকে জিম্মি করে ফেলছে। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও জীবন বাজি রেখে নদী পার হতে হয়। রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট করতে হয়।
ভোলা নদী বন্দরের সহকারী বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম জানান, বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের পক্ষে ট্রলারগুলো বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।