শিরোনাম

মহৎ কাজের জন্য নিজেকে করেছেন উৎস্বর্গ, মৃত্যুর পর পেয়েছেন খেতাব

Views: 75

বরিশাল অফিস :: নির্যাতিত-নিপীরিত, শোষিত-অনুন্নত, শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাদপদ, সামাজিকভাবে অবহেলিত, দরিদ্র-অর্থক্লিষ্ট ও রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত মানুষের সার্বিক উন্নয়ন এবং অধিকার আদায়ের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে তার ছিলো গভীর সম্পর্ক। অবিভক্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রী সভার সমবায় ও ঋণদান মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সোহয়ারর্দীর মন্ত্রী সভার বিচার ও পূর্ত মন্ত্রী, ভারতের অন্তবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী এবং পাকিস্তান সরকারের আইন ও শ্রম মন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।

তিনিই প্রথম সাশনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেছেন। এছাড়াও অবিভক্ত ভারত বাংলা প্রদেশের সাধারণ আসন বরিশালের বৃহত্তর বাকেরগঞ্জের পূর্ব-উত্তর এলাকায় ভোটের মাধ্যমে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল নির্বাচিত প্রথম এমএলএ। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত মৈস্তারকান্দি গ্রামের বাসিন্দা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে নিজেকে উৎস্বর্গ করে দিয়েছেন। যেকারণে তার মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাকে “মহাপ্রান”র খেতাবে ভূষিত করেছেন। এ মহাপ্রান ব্যক্তির ১২০তম জন্মজয়ন্তী উৎসব সোমবার (২৯ জানুয়ারি)। এ উপলক্ষে গৌরনদীর মৈস্তারকান্দি গ্রামের “মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদ”র উদ্যোগে ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

স্মৃতি পরিষদের সংগঠক ডাঃ মনতোষ সরকার জানান, মহৎ কাজের জন্য যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। তাইতো তিনি তার একটি বাণীতে লিখেছিলেন- “যদি আজ কেহ নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারে যে, আমার জীবনের বিনিময়ে আট কোটি তফসিলীর সার্বভৌম মুক্তি আসিবে। তবে আমি সে মৃত্যুকে তিলে তিলে বরণ করিতে পারিবো। যদি সমুদ্রে ঝাঁপ দিলে অথবা জলন্ত অগ্নিকুন্ডে আমাকে নিক্ষেপ করিলে সে মুক্তি মেলে, তবে আমি দুর্বার আকাক্সক্ষা লইয়া তাহাতেই ঝাঁপাইয়া পড়িব।

মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদের ইতিহাস ও গবেষনা বিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ জানান, ১৯০৪ সালের ২৯ জানুয়ারি মৈস্তারকান্দি গ্রামের কৃষক রাম দয়াল মন্ডল ও সন্ধ্যা দেবীর ঘর আলোকিত করে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল জন্মগ্রহন করেন। ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। স্থানীয় বালাবাড়িতে গ্রাম্য পাঠশালার মাধ্যমে তার বাল্য শিক্ষার জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে চতুর্থ শ্রেনীতে বার্থী তাঁরা ইনষ্টিটিউশনে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯২৪ সালে প্রবেশিকা (মেট্রিকুলেশন) পাশ করেন। ওই বছরেই বরিশাল বিএম কলেজে আইএ ভর্তি হন। ১৯২৬ সালে আইএ ও ১৯২৯ সালে বিএ পাশ করেন। ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে কোলকাতা আইন কলেজ থেকে এলএলবি পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে প্রথমে কোলকাতায় ও একই বছরে বরিশালে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত ভারতের আইনসভার একটি মাত্র সাধারণ আসনে তফসিলী জাতির একমাত্র প্রার্থী হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এমএলএ নির্বাচিত হন। এরপর তিনি নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রী সভার সমবায় ও ঋণদান মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পূর্ণরায় এমএলএ নির্বাচিত হয়ে সোহয়ারর্দীর মন্ত্রী সভার বিচার ও পূর্ত মন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পালন করেন। শেষভাগে অবিভক্ত ভারতের অন্তবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ছিলো গভীর সম্পর্ক।

সবশেষে সোহয়ারর্দীর অনেক অনুরোধের পর ১৯৪৭ সালে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী সভার আইন ও শ্রম মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই (যোগেন্দ্রনাথ) প্রথম সাশনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেছেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫০ সালে দেশের রায়ট শেষে তিনি (যোগেন্দ্রনাথ) রায়ট উপদ্রত্য অঞ্চল পরিদর্শন করেন। একপর্যায়ে তিনি তার স্ব-জাতি, অনুন্নত জনসাধারনের জানমাল ও অধিকার রক্ষায় ব্যর্থতা প্রকাশ করে রাজধানী করাচীতে ফিরে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। কিন্তু তার এ পদত্যাগের বিষয়টি কোন ভাবেই মেনে নিতে রাজি হননি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। একপর্যায়ে বীরের বেশে পাকিস্তান থেকে ট্রেনযোগে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। ভারতে ফিরে তিনি আট পৃষ্টায় কারণ উল্লেখ করে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে পাকিস্তান সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র প্রেরন করেন। তৎকালীন সময়ে ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় এ রির্পোটটি ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে শরনার্থীদের কল্যাণেবিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। ১৯৬৮ সালে ভারতের চব্বিশ পরগনার স্ব-জাতি বন্ধুর বাড়িতে খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পরেন তিনি। তড়িঘড়ি করে ভারতে ফেরার পথিমধ্যে মহাপ্রনয়ন ঘটে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের। চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙ্গা এলাকায় তাকে সমাহিত করা হয়েছে। তার মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাকে (যোগেন্দ্রনাথ) মহাপ্রানের খেতাবে ভূষিত করেন। সূত্রমতে, মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের একমাত্র ছেলে জগদ্বীশ মন্ডল (৮৮) পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতেই বসবাস করছেন। মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথের জন্মভূমিতে এখন তার পৌত্রদ্বয় (নাতীরা) বসবাস করন।

যোগেন্দ্রনাথের বড়ভাই মহানন্দ মন্ডলের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ, তার ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ মন্ডল ওরফে ঝন্টু ও প্রদ্বীপ কুমার মন্ডল ওরফে মন্টু তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মৈস্তারকান্দি গ্রামে বসবাস করছেন। দিনমজুরের কাজ করেই চলছে ঝন্টু ও মন্টুর সংসার।

জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে স্থানীয় সেবা আশ্রম প্রাঙ্গনে সোমবার সকালে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ, মহাপ্রান যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের প্রতিকৃতিতে পূস্পার্ঘ অর্পন ও মাল্যদান, শ্রীমদভগবত গীতা পাঠ, দুপুরে ভক্তি গীতির অনুষ্ঠান, মহাপ্রান যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের জিবনী ও সংগ্রামী কার্যক্রমের ওপর আলোচনা সভা এবং কবি গানের আয়োজন করা হয়েছে।

 

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *