শিরোনাম

মালদ্বীপের মুইজ্জুর ভারতবিরোধিতার খুঁটির জোর কোথায় ?

Views: 49

চীনপন্থী বলে পরিচিতি আছে মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর। নির্বাচিত হওয়ার পর কয়েক মাসে তাঁর বক্তব্য ও বিভিন্ন সিদ্ধান্তে এর প্রতিফলন মিলেছে। ভারতের বিরুদ্ধে জোরালো মন্তব্য ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি। মুইজ্জুর খুঁটির জোর কোথায়- এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ভারত ও চীনের গণমাধ্যমগুলো। ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ খান

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই মুইজ্জু মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাদের সরিয়ে দুই মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে। ভারতের সঙ্গে হাইড্রোগ্রাফিক চুক্তিও বাতিল করেছে এই দ্বীপদেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লাক্ষা দ্বীপ সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সরকার তো বটেই জনগণের মধ্যেও সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। মুইজ্জুর চীন সফরের পর ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক নিয়ে আরো নতুন করে ভাবছেন বিশ্লেষকরা।

মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিবেচনায় তাঁদের ধারণা, মুইজ্জু তাঁর পূর্বসূরির ভারতঘেঁষা নীতি থেকে বেরিয়ে আসবেন। অবশ্য এরই মধ্যে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম স্লোগানই ছিল ‘ভারত হটাও’। ভারতীয় বিশ্লেষকদের অনুমান, মালদ্বীপের পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস ও প্রগ্রেসিভ পার্টির জোট সরকার সামনের দিনগুলোতে চীন ঘেঁষা নীতিই অনুসরণ করবে।

জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে মুইজ্জু চীন সফরে যান। সেখানে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভসহ অবকাঠামো ও পর্যটন খাত নিয়ে সরকার-সরকার সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। দুই রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে চীন-মালদ্বীপ অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার কর্মপরিকল্পনা স্বাক্ষরিত হয়। পাশাপাশি বেল্ট অ্যান্ড রোড, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি, অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনগণের জীবিকা, সবুজ উন্নয়ন এবং ব্লু ও ডিজিটাল অর্থনীতি বিষয়ে সহযোগিতার নথিপত্রও স্বাক্ষরিত হয়।

গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রচারের সময় মোহাম্মদ মুইজ্জু অভিযোগ করেন, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ দেশে ভারতের প্রভাব বাড়াচ্ছেন। সে সময় মুইজ্জু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি দেশে ভারতের প্রভাব কমাবেন। তারই ধারাবাহিকতায় মালদ্বীপ থেকে ভারতের সেনা সরিয়ে নেওয়ার আল্টিমেটাম, হাইড্রোগ্রাফিক সমীক্ষা চুক্তি বাতিল এবং মুইজ্জুর চীন সফর।

মালদ্বীপের জনগণের মধ্যেও ভারতবিরোধী মনোভাব বেশ স্পষ্ট। তার একটি উদাহরণ হলো—মালদ্বীপের রাজধানী মালের কাছে উথুরু থাইলাফালহুতে ভারতের সহায়তায় নির্মাণাধীন একটি ডকইয়ার্ড। এই বিষয়ে মালদ্বীপের জনমনে ধারণা, সেখানে ভারত ডকইয়ার্ডের আড়ালে মূলত একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।

সর্বশেষ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে করা ‘কটূক্তির’ পরিপ্রেক্ষিতে মালদ্বীপের ৩ মন্ত্রীর বরখাস্ত হওয়ার বিষয়টিও ভালোভাবে নেয়নি মালদ্বীপের জনগণ। বিষয়টি ভারতের বিপরীতে মালদ্বীপের জনগণকে বিরূপ করে তুলেছে। বিপরীতে ভারতীয় সাধারণ জনগণও মালদ্বীপ বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন। স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে, সরকার-সরকার তো বটেই জনগণের পর্যায়েও দুই দেশের সম্পর্ক আর আগের জায়গায় নেই।

ভারতের সঙ্গে যখন মালদ্বীপের বিরোধ তুঙ্গে, ঠিক তখনই চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে মসৃণ গতিতে। এ বিষয়ে মুইজ্জুর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, তিনি চীনে তাঁর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে ব্যাপক সম্মানিত হয়েছেন এবং চলতি বছর প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চীন সফর করার পর বেইজিং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নে যে গুরুত্ব দিচ্ছে, তার পূর্ণাঙ্গ প্রমাণ পেয়েছেন।

বৈঠকে মুইজ্জু চীনা প্রেসিডেন্টকে বলেন, চীন তাঁর দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মূল্যবান সহায়তা প্রদান করেছে। মালদ্বীপের জনগণ বিআরআই থেকে অনেক উপকৃত হয়েছে, মালদ্বীপ-চীন মৈত্রী সেতুকে দুই দেশের মধ্যে বন্ধনের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের কথা থেকে স্পষ্ট, ভারতের পরিবর্তে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতেই আগ্রহী দেশটি এবং চীনা সমর্থন তাঁর ভারতবিরোধী মনোভাবের অন্যতম খুঁটি।

চীনের তরফ থেকে মুইজ্জু ও তাঁর সরকারকে চীনের অকুণ্ঠ সমর্থনের বিষয়টি নিশ্চিত হয় সির বক্তব্য থেকে। মুইজ্জুর সঙ্গে বৈঠকে সি বলেছিলেন, চীন মালদ্বীপের সঙ্গে সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে, উন্নয়ন কৌশলের সমন্বয় শক্তিশালী করতে, উচ্চমানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার এগিয়ে নিতে এবং চীন-মালদ্বীপের বন্ধুত্বের এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে প্রস্তুত। এই নতুন মানদণ্ডের একটি শর্ত যে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে নেওয়া তা সাদা চোখেই বোঝা যায়।

মালদ্বীপে চীনের প্রভাব বাড়ানোর ভূকৌশলগত গুরুত্বও আছে। ভারত মহাসাগরে চীনের জন্য মালদ্বীপ কৌশলগত দিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক বাণিজ্য মহাসড়কের এমন এক অবস্থানে আছে, যেখান দিয়ে চীনের জ্বালানি তেলের ৮০ শতাংশই পরিবাহিত হয়। ফলে চীন এই সরবরাহ লাইনে বরাবর নিজের উপস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা করবে তাই স্বাভাবিক।

তবে চীনের জন্য বিষয়টি লাভজনক হলেও এই অবস্থা অবশ্যই ভারতের জন্য উদ্বেগজনক। দলমত-নির্বিশেষে মালদ্বীপ যে ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি স্বীকার করবেন। যেমনটা স্বীকার করেছেন, ক্ষমতাসীন বিজেপি প্রধান প্রতিপক্ষ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শশী থারুর।

মালদ্বীপে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিষয়ে সতর্ক করে শশী থারুর বলেছেন, ‘চীন যে আমাদের চারপাশ ঘিরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিবেশী প্রতিটি দেশে সঙ্গে দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাব দৃশ্যমান।’

তথ্যসূত্র: গ্লোবাল টাইমস, দ্য ওয়্যার, এনডিটিভি ও চায়না ডেইলি

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *