শিরোনাম

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বাড়ছে পটুয়াখালীর মৃৎ শিল্পের বাজার

Views: 52

মো: আল-আমিন (পটুয়াখালী): দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পের একটি মৃৎ শিল্প। এক সময় রাজশাহী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইলসহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর কারিগরদের রাজত্ব ছিল একচেটিয়া। তাদের তৈরি নানা তৈজসপত্র ছিল বাংলার সংস্কৃতির অংশ, যা আজ মৃতপ্রায়। তবে কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যবাহী সে শিল্পকে বংশপরম্পরায় এখনো আঁকড়ে রেখেছেন পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মৃৎশিল্পীরা। তাদের তৈরি পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রফতানিও হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোয় বাড়ছে এর বাজার।

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন অসংখ্য মৃৎশিল্পী। এলাকাগুলো পরিচিত পালপাড়া নামে। এর মধ্যে মদনপুরা ইউনিয়নের পালপাড়ায় গিয়ে জানা যায়, মৃৎ শিল্পের জন্য প্রায় শতবছর ধরে এলাকাটি সর্বত্র পরিচিত। একসময় এখানকার তৈরি মাটির খেলনা ও তৈজসপত্র বিক্রি হতো গ্রামীণ বৈশাখী মেলায়। প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর নকশার আধুনিকতায় পরে এর বাজার ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকায়ও। এখন আর শুধু খেলনা নয়, মাটির তৈরি ফুলদানি, ডিনার সেট, কাপ-পিরিচ, মগসহ বিভিন্ন শো-পিস তৈরি হয় পালপাড়ায়; যার বাজার রয়েছে দেশের বৃহৎ হস্ত ও কারুশিল্প ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আড়ংসহ রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে বিদেশের বাজারেও।

বাউফল পৌর শহরের বলরাম পালের ছেলে কমল পাল। বংশপরম্পরায় বাপ-দাদার পেশা মৃৎ শিল্পের হাল ধরেছেন। তার অধীনে কাজ করছেন অনেক কারিগর। প্রতিদিন সকাল থেকেই নানা মৃৎপণ্য তৈরির কাজে লেগে পড়েন তারা।

মাটি মোল্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কার্যক্রম। পরে মাটির পরিমাপ, পণ্যের রূপ, নকশা, পলিশ ও রোদে শুকানোর পর তুলির আঁচড়ে রাঙিয়ে তোলা হয়। বাজারজাত করতে সবশেষ চলে প্যাকেজিং। শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি মৃৎপণ্য এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য, স্পেন, জাপানসহ মোট ২৪টি দেশেও রফতানি হচ্ছে।

ব্যবসায়ী কমল পাল জানান, তিনি প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকার পণ্যসামগ্রী বিক্রি করেন। বাজারে পুরনো জিনিসের কদর না থাকায় এখন তৈরি করেন সব আধুনিক সামগ্রী, যার বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি ব্যবসার পরিধি বড় করতে পারছেন না বলে জানান।

জানা যায়, বাউফলে চার শতাধিক মৃৎ শিল্প পণ্যের দোকান বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সব মিলে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকার সামগ্রী বিক্রি করা হয়। আর কর্মসংস্থান হয়েছে পাঁচ হাজার নারী-পুরুষের। তবে পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকই বেশি। বর্তমানে বিভিন্ন উপকরণের দাম, পুঁজি সংকট, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় অভাব-অনটনের মধ্যে দিনযাপন করছে মৃৎ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক পরিবার। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়।

এছাড়া কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করায় লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। অনেক ব্যবসায়ী আবার ঋণের বোঝা বইতে না পেরে ব্যবসাই গুটিয়ে নিচ্ছেন। তাই মৃতপ্রায় এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন কারিগররা। সহজ শর্তে ঋণ বা প্রণোদনাসহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন আগের মতো মাটি সংগ্রহ করতে পারছেন না মৃৎ শিল্প ব্যবসায়ীরা। ফলে বেশি টাকা খরচ করে মাটি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এছাড়া জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় মাঝে মাঝে উৎপাদিত জিনিসপত্র বিক্রি করতে গিয়ে তাদের লোকসান গুনতে হয়। আবার বর্তমান বাজারে মাটির জিনিসপত্রের স্থান দখল করে নিয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক পণ্য। তাই ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) পটুয়াখালী জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক আলমগীর সিকদার।

তিনি বলেন, ‘কালের আবর্তনে বাজারে পুরনো জিনিসের কদর না থাকায় কারিগররা এখন আধুনিক সব সামগ্রী তৈরি করায় বাজারে এর চাহিদা বাড়ছে। বিদেশেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই ব্যবসার পরিধি বাড়াতে মৃৎ শিল্প ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় উদ্যোগ নেয়া হবে।’

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *