একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলো আজও হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে। বাবার নিথর দেহ দেখে হতবিহ্বল মা, আর সেই বেদনা নিয়েই টিকে থাকা ছিল এক অভাবনীয় সংগ্রাম।
১৯৭১ সালে এক সপ্তম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে আমি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ করছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর বরিশাল শহর থমথমে হয়ে ওঠে। মানুষের মুখে মুখে কানাঘুষা: “ঢাকায় কী হচ্ছে!” সবার মধ্যে এক অদ্ভুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
আমার বাবা বিএম স্কুলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। পাশাপাশি রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ছিলেন সক্রিয়। ৭ মার্চের ভাষণের পর তাঁকে মনে হয়েছিল গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমাদের জীবনে নেমে আসে ভয়ংকর এক অধ্যায়।
মে মাসের এক সকালে পাকিস্তানি সেনারা বরিশালে ঢুকে এলোপাতাড়ি বোমা বর্ষণ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। পরদিন কৌতূহলবশত বাবার সঙ্গে গিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছিলাম। তবে একদিন হঠাৎ বাবা কোথায় যেন হারিয়ে যান। মা ও আমি সারাদিন ধরে তাঁকে খুঁজলাম, কিন্তু কোনো খোঁজ পেলাম না। কয়েক দিন পর জানলাম, বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিতে ঝালকাঠি জেলার বাউকাঠির আটঘরে গিয়েছেন।
ঝালকাঠির আটঘর পেয়ারাবাগানের জন্য বিখ্যাত, যা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা এটিকে আক্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিল। ২৪ মে ভোরে সেখানকার নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। মায়ের অনুচ্চারিত শঙ্কা সেদিনই সত্যি হয়। যুদ্ধ শেষে মা আমাকে নিয়ে যখন কুড়িয়ানায় পৌঁছালেন, তখন সেখানে লাশের স্তুপ। মায়ের শঙ্কা সত্যি হলো—তিনি লাশের ভিড়ে বাবার ঝাঁঝরা দেহ খুঁজে পেলেন।
বাবার মরদেহ দেখে মায়ের আকুতি হৃদয়বিদারক ছিল। উপস্থিত মানুষদের সহায়তায় সনাতন ধর্ম অনুযায়ী বাবাকে সমাহিত করা হয়। এরপর মা আমাকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান কলকাতার শরণার্থীশিবিরে। সেখানেই দেশ স্বাধীন হওয়ার দিন পর্যন্ত আমাদের বেঁচে থাকা।
দেশ স্বাধীন হলে আমরা আবার বরিশালের বাড়িতে ফিরি। মা বাবার স্মৃতি আঁকড়ে দীর্ঘ ৪০ বছর বেঁচে ছিলেন। আমি আজও তাঁদের সেই ত্যাগের স্মৃতি গর্বের সঙ্গে ধারণ করে বেঁচে আছি।
মো: তুহিন হোসেন,
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, চন্দ্রদ্বীপ নিউজ ২৪ ডট কম