শিরোনাম

শিশুদের কলরবে মুখরিত পুরো চর

Views: 60

পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর কয়েকটি উপজেলা খুবই দুর্গম। যাতায়াতে দুর্গম এসব উপজেলার বেশ কিছু চর আছে, যেখানে পৌঁছানো অনেক কষ্টকর। এই অঞ্চলগুলোর শিক্ষার অবস্থা খুবই নাজুক। পড়ালেখার সুযোগ কম থাকায় শিশুরা অল্প বয়স থেকেই কাজে লেগে যায়।

মা-বাবার মতো এক সময় তারাও ঝুঁকে পড়ে কৃষি কাজ কিংবা মাছ ধরার কাজে। এসব অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষের পেশা মাছ ধরা ও কৃষি কাজ। অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই অবস্থায় সন্তানদের কষ্ট করে একটু দূরের স্কুলে পড়ানোর কথা ভাবতেও হয়তো ভয় পায় মানুষগুলো।

প্রকৃতির সঙ্গে নিয়মিত লড়াই করে বেঁচে থাকা এই মানুষদের কথা বিবেচনা করে গলাচিপা, দশমিনা ও রাঙ্গাবালী উপজেলার তিনটি অতি দুর্গম চরে স্কুল করে দিয়েছে দেশের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ। যে শিশুরা একসময় স্কুলে যাওয়ার কথা চিন্তাও করত না, তারা এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। তাদের কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো চর। তিনটি চরের বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলে এখন তিন শতাধিক শিশু পড়াশোনা করছে।

আরো পড়ুন : দুমকীতে ২৪টি কেউটে সাপের বাচ্চা হত্যা ও মা সাপ উদ্ধার

তেঁতুলিয়া নদীর কোল ঘেঁষে গলাচিপার চরবিশ্বাস ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের চর আগস্তি গ্রাম। গ্রামের বড় একটি অংশের সঙ্গে জুড়ে আছে ঘাসির চর। রাঙ্গাবালী উপজেলা ও গলাচিপা উপজেলার সীমান্তবর্তী হওয়ায় এই অংশটি বেশ অবহেলিত বলা যায়। এখানে তিন শতাধিক পরিবারের বাস। প্রতিদিন জোয়ার-ভাটায় চরে পানি ওঠে।

চর আগস্তির এই গ্রামটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এক বছর আগেও চরটিতে কৃষকের হাঁকডাক এবং জেলেদের ডাকচিৎকার ছাডা আর কিছুই শোনা যেত না। কিন্তু এই দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গেছে ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল’ প্রতিষ্ঠার পরই। বেড়িবাঁধের একটু দূরেই (পশ্চিম পাশে) নির্মাণ করা হয়েছে দক্ষিণ চর আগস্তি মুজিব কেল্লা বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল। সুবজের মাঝে লাল-সাদা ভবনটি প্রতিদিন শতাধিক শিক্ষার্থীর কলরবে মুখরিত থাকে। বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকার মানুষ এসে ঘুরে যায় স্কুলে। দেখে যায় বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের কার্যক্রম। বিশাল এই চরে সবুজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল। পিছিয়ে পরা এই গ্রামের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে স্কুলটি। গ্রামটির বিভিন্ন দিক থেকে ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আসা শিক্ষার্থীদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এলাকার মানুষ। বিচ্ছিন্ন এই এলাকার শিক্ষার্থীরা এভাবে জামা, প্যান্ট, জুতা, ব্যাগ নিয়ে সেজেগুজে স্কুলে আসবে, এটা যেন তাদের কাছে স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তব করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। তাইতো গ্রামের মানুষ সব সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতি।

দক্ষিণ চর আগস্তি বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ সাহিন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন আল হেলাল, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মীর মো. রেজাউল ইসলাম প্রমুখ পরিদর্শন করেছেন। বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় বসুন্ধরা শুভসংঘের এই উদ্যোগকে তাঁরা স্বাগত জানিয়েছেন। বসুন্ধরা গ্রুপের এমন উদ্যোগুলো আরো বিস্তৃত হোক, এটাই চেয়েছেন সবাই।

তাঁরা বলেছেন, দেশসেরা শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরার কল্যাণে উপকৃত হচ্ছে প্রান্তিক অসহায় পরিবার ও তাদের সন্তানরা। বসুন্ধরা গ্রুপ বলেই এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। বসুন্ধরা পরিবারের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা।

দক্ষিণ চর আগস্তির ঘাসির চরের কৃষক আলকেস মৃধা বলেন, ‘আমার তিন ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে বিয়ে দিছি। মাইজ্জা পোলা তৃতীয় শ্রেণিতে দূরের একটা স্কুলে পড়ে। সাড়ে চাইর বছরের একটা ছোট মাইয়া আছে। আমি এই মাইয়াডারে বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলে ভর্তি করামু। বাড়ির ধারে স্কুল, এইডাই আমাগো বড় সুবিধা, যদিও একটা হাক্কা (সাঁকো) পার হইয়া আইতে হইবে। তাতেও সমেস্যা নাই। দূরের চাইয়্যা হাক্কা পারানো সহজ। আমাগো মতো গরিব মাইনসের পোলাপানরে জামা, প্যান্ট, জুতা, ব্যাগসহ লেহাপড়ার সব এমন করে কেউ দেয় নাই। একমাত্র বসুন্ধরাই দিছে। স্কুল শুরু হইলে আমি প্রায়ই আইয়া চাইয়া দেহি আমাগো গেরামের ছোট ছোট পোলাপান একই জামাকাপড়, জুতা, ব্যাগ লইয়া স্কুলে যায়, পরানডা ভইরা যায়। আমার ধারে স্বপ্নের লাহান লাগে।’

আরো পড়ুন : লবনাক্ত জমিতে কোলেস্টেরল মুক্ত তৈলের হাতছানি দিচ্ছে হাইব্রিড সূর্যমুখী

দশমিনার চরবোরহানে বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল। উত্তাল তেঁতুলিয়া নদী পাড়ি দিয়ে ওপারের চরবোরহানে যেতে হয়। যোগাযোগের মাধ্যম মাত্র একটি ট্রলার। তা-ও দিনে একবার যাতায়াত করে। চরটি প্রায় চার দশক আগে জেগে উঠলেও বসতি মাত্র দুই দশক ধরে। নেই কোনো বেড়িবাঁধ। তাই জলোচ্ছ্বাস কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে লড়াই করে বাঁচতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। মৌলিক চাহিদা তো দূরে থাক, স্বাভাবিক জীবনযাত্রাই এখানে কঠিন। চরের বেশির ভাগ পরিবার মাছ ধরা বা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাইতো পড়াশোনা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। পরিবারের সঙ্গে কাজ করতে ক্ষেতে বা নৌকায় মাছ ধরতে দেখা যায় সাত-আট বছরের শিশুদের। এসব দেখে এগিয়ে আসেন বসুন্ধরা শুভসংঘের সদস্যরা। শত প্রতিকূলতাও থামাতে পারেনি শুভসংঘ বন্ধুদের। শিশুদের জন্য বর্ণমালার বই হাতে ছুটে চলা এই উদ্যমী তরুণদের দমিয়ে রাখতে পারেনি উত্তাল নদীও। দরিদ্র পরিবারের কোমলমতি শিশুদের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের আর্থিক সহায়তায় গড়ে তুলেছেন বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে স্কুলটি। দশমিনার আলিপুর লঞ্চঘাট থেকে উত্তাল তেঁতুলিয়া নদীতে প্রায় এক ঘণ্টা পাড়ি দিতে হয়। পূর্ব পাশে ভোলা জেলা, দক্ষিণে গলাচিপা উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে চরবোরহান। তেঁতুলিয়া নদীর তীরেই জেগে ওঠা চরবোরহানের আবাসন প্রকল্প এলাকায় টিনের চালের একটি ঘরে ৮০ জন শিশু নিজেদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে অবিরত চেষ্টা চালাচ্ছে। এসব শিশুকে জামা, জুতা, ব্যাগ, শিক্ষা উপকরণ, স্কুলের অবকাঠামো, বৈদ্যুতিক পাখাসহ সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপ। নতুন জামা, ব্যাগ, জুতা হাতে পেয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে শিশুরা। শিশুদের চোখেমুখে আনন্দের হাসি।

শিক্ষার্থী রুবাইয়ার মা লিপি বেগম বলেন, ‘আমি তো মেয়ের পড়াশোনার কথা চিন্তাই করি নাই। আমাগো ভাগ্য অনেক ভালো, বসুন্ধরা গ্রুপ আমাগো মতো গরিব মাইনসের মাইয়া-পোলার কথা চিন্তা কইররা স্কুল করছে।’

রাঙ্গাবালীর বিচ্ছিন্ন চর ইমারশনে কোনো স্কুল না থাকায় নদী পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হতো শিক্ষার্থীদের। পুরো জেলা থেকেই স্থলপথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন উপজেলা রাঙ্গাবালী। এই উপজেলার একেকটি চরে যেতে পোহাতে হয় নানা দুর্ভোগ। সেই চরগুলো থেকে শিশুরা শিক্ষা নিতে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে চায় না। মা-বাবারাও শিশুদের এত দূরে দিয়ে পড়ালেখা করাতে চান না। এসব কিছু বিবেচনা করে চর ইমারশনে একটি স্কুল করার সিদ্ধান্ত নেয় বসুন্ধরা শুভসংঘ। স্কুলহীন চর ইমারশন এখন বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুলের শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। অভিভাবকরাও এখন নিশ্চিন্ত মনে সন্তানদের স্কুলে পাঠান।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *