পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী জেলা পটুয়াখালীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অনেক নদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় নদ-নদীর সংখ্যা ৩৭টি। ভাটিতে অবস্থানের কারণে এক-দেড় দশক আগেও এগুলো ছিল বেশ প্রশস্ত ও খরস্রোতা। কিন্তু গত কয়েক বছরে জেলাটির নদীগুলোর গভীরতা ও প্রশস্ততা হারিয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। দখল, অপরিকল্পিত নদী শাসন, অবকাঠামো নির্মাণ ও পলি পড়ে সংকীর্ণ ও অগভীর হয়ে পড়ছে নদীগুলো।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ৩৫ বছর আগে করা মানচিত্রের সঙ্গে নদীগুলোর বর্তমান মানচিত্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময় জেলার নদ-নদীগুলোর অনেক স্থানেই প্রশস্ততা নেমে এসেছে আগের তুলনায় অর্ধেকে। প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে নাব্য সংকটে ভোগা সংকীর্ণ এলাকার পরিমাণ।
পটুয়াখালীর অন্যতম প্রধান নদী গলাচিপা। নদীটির বিভিন্ন পয়েন্টে গত ৩৫ বছরে প্রশস্ততা ও গভীরতা কমে নেমে এসেছে এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশে। বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, এ সময় শেখাটি এলাকায় গভীরতা কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। ১৯৮৮ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে শেখাটি এলাকায় নদীর গভীরতা ছিল তিন থেকে নয় মিটার পর্যন্ত। বর্তমানে নদীর এ অংশে প্রায় আড়াই হাজার মিটারজুড়ে গভীরতা এক মিটার বা এরও কম। কলাগাছিয়া অংশে ১৯৮৮ সালে নাব্য ছিল চার থেকে ১১ মিটার পর্যন্ত। বর্তমানে তা নেমে এসেছে এক থেকে চার মিটারে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শুষ্ক মৌসুমে নাব্য সংকটে নদীটি দিয়ে ভারী ও মাঝারি নৌযান চলাচল এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশেষ করে শেখাটি ও কলাগাছিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ কমে এ সংকট মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়।
গলাচিপা পৌরসভার অভ্যন্তরে ও চিকনিকান্দি বাজারসংলগ্ন এলাকায় নদীটি এখন সংকীর্ণ হয়ে খালের আকার ধারণ করেছে। সংকীর্ণ হয়ে পড়ায় এ এলাকায় ভারী ও মাঝারি নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। আবার নদীর গলাচিপা পৌর এলাকার মধ্যকার অংশটি এখন প্রায় পুরোপুরিই দখলদারদের আওতায়।
নদীর এসব এলাকা দখলমুক্ত করতে কাজ করা হচ্ছে বলে দাবি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।
পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এসএম শাহজাদা বলেন, ‘পৌর এলাকার মধ্যে নদী দখলমুক্ত করতে এবং পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে কাজ করা হচ্ছে। নাব্য ও গভীরতার সংকটের বিষয়ে অভিযোগ পেলে আমরা ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেব।’
গলাচিপা নদীর মতোই জেলার আগুনমুখা, লোহালিয়া, কোরালিয়া নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে গভীরতা ও প্রশস্ততা কমে অর্ধেক থেকে এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। নদীগুলোর এমন পরিস্থিতির জন্য বিআইডব্লিউটিএ দখলের পাশাপাশি দায়ী করছে উজান থেকে পানিপ্রবাহ হ্রাস ও পলিপ্রবাহ বেড়ে যাওয়াকে। গভীরতা ও প্রশস্ততা ঠিক রাখতে পটুয়াখালীর নদ-নদীগুলোয় নিয়মিত ড্রেজিং করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
বিআইডব্লিউটিএর বন্দর ও পরিবহন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, ‘গেজেট অনুযায়ী নদীবন্দরের আওতাভুক্ত জায়গাগুলোয় কেউ অবৈধভাবে দখল করলে তা যথাসম্ভব দ্রুত উচ্ছেদ করা হয়। এছাড়া নদীগুলোয় নিয়মিত ড্রেজিংও করা হয়। তবে যেহেতু উজান থেকে পানিপ্রবাহ কম এবং বন্যায় যে পানিপ্রবাহ হচ্ছে সেখানে পলি অনেক বেশি, তাই নদীগুলোর গভীরতা কমে যাচ্ছে।’
আরো পড়ুন : গ্রেপ্তারি পরোয়ানা: আইসিসির ওপর নিষেধাজ্ঞার আভাস যুক্তরাষ্ট্রের
একসময় জেলার অন্যতম খরস্রোতা নদী ছিল আগুনমুখা। পানিপ্রবাহ হ্রাস ও পলি পড়ে নদীটিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ডুবোচর। কঠিন হয়ে পড়েছে নৌ-চলাচলও। নদীটির উত্তরে গলাচিপা উপজেলা, দক্ষিণে রাঙ্গাবালী উপজেলা ও পশ্চিমে পায়রা সমুদ্রবন্দর। বিশেষত রাঙ্গাবালী উপজেলার মানুষের কোনো স্থানে যাতায়াত করতে হলেই এ নদী পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে নদীটিতে ডুবোচরের সংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। ফলে এটিও এখন দিনে দিনে ভারী ও মাঝারি নৌযান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
জেলার গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি নদী লোহালিয়া। এখানে ১৯৮৮ সালেও গভীরতা ছিল ৩ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে এখানে নদীর নাব্য হ্রাস পেয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। বিশেষ করে গত দুই দশকে নদীটির প্রস্থ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পটুয়াখালীর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে পটুয়াখালী শহরে লোহালিয়া নদীর প্রস্থ ২ নং বাঁধঘাটে ছিল ১৬০ মিটার। এখন আছে ৯১ মিটার। উত্তর ধরান্দী লঞ্চঘাটে নদীর প্রস্থ ৩২৫ মিটার থেকে নেমে এসেছে ১১৫ মিটারে। ২০ বছরের ব্যবধানে কৌরাখালী খেয়াঘাটে নদীর প্রশস্ততা ৩২৫ থেকে ২৫৩ মিটারে নেমে এসেছে। এছাড়া এ সময় নদীর প্রশস্ততা সেয়াকাটি খেয়াঘাটে ৩৫৩ থেকে ২৯৬ মিটারে ও বগা ফেরিঘাটে ২৪৪ থেকে ১৯০ মিটারে নেমে এসেছে।
সরজমিনে দেখা গেছে, নদীটির এ অংশগুলোর অধিকাংশ স্থানেই নানা জায়গা বেদখল হয়ে পড়েছে। এমনকি কোনো কোনো স্থানে নদী-তীরবর্তী কম নাব্য অংশ ভরাট করে দোকান, আবাসিক ভবন ও বাজার গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, জেলার নদীগুলোয় দখলদারের সংখ্যা ৯৯৯। এর মধ্যে পটুয়াখালী সদরে ৩০১ আর গলাচিপা উপজেলায় ২৮৯ জন। এছাড়া কলাপাড়ায় ১৮৬ ও রাঙ্গাবালীতে আছে ৫৫ জন। বাকিরা অন্যান্য উপজেলার বাসিন্দা। বর্তমানে দখলদারের সংখ্যা অনেক বেশি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তবে জেলা প্রশাসনের দাবি, পটুয়াখালীর নদীগুলোকে দখলমুক্ত করতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. নূর কুতুবুল আলম বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অবৈধ দখল উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করি। এছাড়া নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিতেও কাজ চলছে। বেশকিছু স্থানে ড্রেজিংয়ের জন্য নতুনভাবে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।’
নদীগুলোর এমন পরিস্থিতির জন্য দখলের পাশাপাশি অপরিকল্পিত স্লুইস গেট ও সেতু নির্মাণও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন পানি বিশেষজ্ঞরা।