পটুয়াখালী প্রতিনিধি : কুয়াকাটা সৈকত থেকে ছয় কিলোমিটার পূর্বে গঙ্গামতি এলাকা। শীত মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ এলাকার চরে অবৈধ সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল (ঘোপ জাল) বা চরগড়া দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। দিনে ভাটার সময় নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে খুঁটি ও জাল প্রস্তুত রাখেন জেলেরা। রাতে ও ভোরে জোয়ারের পানিতে সৈকত তলিয়ে গেলে জাল টেনে পানি ছেঁকে মাছ ও পোনা আটকানো হয়। এভাবে বড় মাছের পাশাপাশি পোনা ধ্বংস হচ্ছে।
কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এলাকায় অবৈধ জাল দিয়ে এভাবে পোনা ধ্বংসের সব আয়োজন করেছেন অসাধু জেলেরা। এ জালের ব্যবহারে জাটকাসহ ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়ছে। এভাবে যথেচ্ছ পোনা নিধনে মৎস্য সম্পদ হুমকিতে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবৈধ জাল দিয়ে মাছ শিকার করেন গঙ্গামতি এলাকার জেলে মনির। তিনি বলছিলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে আমার একটি জাল তুলে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে। তারপর নতুন জাল কিনে মাছ ধরতে এসেছি। আমরা গরিব মানুষ, কী করে খাব? তাই এগুলো ধরি। তবে এগুলো অবৈধ জাল।’ মাছ ধরার জন্য কাউকে টাকা দেন না বলে দাবি তাঁর।
অবৈধ জালের ফাঁদ পাততে গাছ ব্যবহার করায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলও হুমকিতে রয়েছে। বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলেরা অবৈধ জালে ব্যবহারের জন্য বনের গাছ কাটছে। এরই মধ্যে কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।
প্রতিদিন যে পরিমাণ মাছ এ জালে আটকে মারা যাচ্ছে, তাতে কিছুদিন পর সাগরে কিছু পাওয়া যাবে না বলে মত মো. খলিল নামে এক জেলের।
তাঁর ভাষ্য, দুই মাসে একজন জেলে যে পরিমাণ পোনা বিক্রি করছেন, তার দাম অন্তত ১০ লাখ টাকা। এ মাছ দুই মাস পরে ধরা হলে দাম হতো কয়েক কোটি টাকা। তা থেকে সবাই বঞ্চিত হচ্ছে। দ্রুত ছোট মাছ নিধন রোধে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কুয়াকাটা সৈকতসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের গভীরে জেগে ওঠা চরবিজয়, গঙ্গামতি, লেম্বুরবনসহ বিভিন্ন চরে অবৈধ জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন জেলেরা। চরগুলোয় অন্তত ৫০টি ঘোপ বা চরগড়া দিয়ে জাটকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা ধরা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এ কাজ করছেন কিছু অসাধু জেলে। তবে সাধারণ জেলেরা মৎস্যসম্পদ রক্ষা ও ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে অবৈধ চরগড়া, ঘোপ, চিংড়ি, বেহুন্দি ও কারেন্ট জাল ব্যবহার বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
অবৈধ জাল দিয়ে যারা মাছ শিকার করেন, তাদের প্রশাসনের চেয়েও ক্ষমতাধর বলে মনে করেন গঙ্গামতি গ্রামের জেলে হেলাল মৃধা।
তাঁর ভাষ্য, যে কেউ চাইলে এ জাল দিয়ে মাছ ধরতে পারে না। প্রভাবশালী ও প্রশাসনকে ম্যানেজ না করে পোনা শিকার সম্ভব নয়। সাগরের মোহনায় জেগে ওঠা চরে মাছ শিকারের সময় পোনা মারা পড়ছে। ফলে মৎস্য সম্পদ হুমকিতে পড়বে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি বেহুন্দি জালে গড়ে ১০ থেকে ১৫ কেজি মাছের পোনা ধরা পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে কোস্টগার্ড দুটি বোটে দুই কোটি ফাইস্যা মাছের পোনা পায়। পরে সেগুলো অবমুক্ত করা হয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান জানান, দুই মাসে অন্তত ৩০টি অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় ২২০টি বেহুন্দি এবং ৫০ হাজার মিটার কারেন্ট ও চরগড়া জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়।
পোনা নিধন করায় সামুদ্রিক মাছের সংকট দেখা দিতে পারে বলে মত ওয়ার্ল্ডফিশ (ইকোফিশ-২) প্রকল্পের সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতির।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে, তাতে অন্তত ৩০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে বলে মনে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। এগুলো বন্ধ করতে পুরো সিস্টেমের পরিবর্তন আনতে হবে। জাল তৈরির কারখানা, আড়তে পোনা বিক্রি বন্ধ এবং প্রশাসনের নজরদারি থাকতে হবে।
প্রতিটি স্থানে একাধিকবার অভিযান চালালেও অবৈধ জালের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না।
জায়গাগুলো শনাক্ত করে নদীপথে অভিযান চালালেও পোনা শিকার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করেন উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান। তিনি জানান, এবার কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশের সহযোগিতায় অভিযান চালানো হবে।
আইন অনুযায়ী, আড়াই ইঞ্চি ফাঁসের নিচে সব জাল অবৈধ।
মৎস্য কর্মকর্তার নির্দেশে এ ধরনের অবৈধ জাল জব্দ করে ধ্বংস করছেন বলে জানান কুয়াকাটা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, নৌযান ও জনবলের সংকট থাকায় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।