শিরোনাম

সর্বত্র শৃঙ্খলা ফেরানো বড় চ্যালেঞ্জ

Views: 24

চন্দ্রদ্বীপ নিউজ :: সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমেছে স্থবিরতা। স্থানীয় সরকার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সেবা কার্যক্রম দৃশ্যত বন্ধ রয়েছে। পাসপোর্টসহ অধিকাংশ সরকারি সেবা প্রায় অচল।

দূরপাল্লার বাস চলাচল করলেও ট্রেনের সেবা এখনো চালু হয়নি। প্রশাসনে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। চেয়ার হারাবে কে আর কে নতুন চেয়ার পাবে সেই হিসাব ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে। সরকারের পটপরিবর্তনে বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি নিয়েও দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।

একপক্ষকে হটিয়ে আরেকপক্ষ দখল নেওয়ারও ঘটনা ঘটছে। পুরনো মুখ সরিয়ে পরিবহন খাতসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে নতুন মুখ। চরম অস্থিরতা শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে। অস্থিরতা চলছে পুলিশ বিভাগে। একই অবস্থা বিচার অঙ্গনে। নিম্ন আদালত চালু থাকলেও উচ্চ আদালত বন্ধ রয়েছে। আছে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা। কারাগারে একের পর এক বিদ্রোহ ও বন্দি পালানোরও ঘটনা ঘটছে।

এই অবস্থায় সারাদেশে বিভিন্ন খাতে এখন শৃঙ্খলা ফেরানোই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এখন বর্তমান সরকারের এখন প্রথম অগ্রাধিকার হতে হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভীতি রয়েছে তা দূর করা। তাদের মতে, অর্থনীতির চাকা সচল রাখা; সব সরকারি সেবা, প্রশাসনিক ও পুলিশি কার্যক্রম চালু; যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন; প্রশাসন, বিচারালয় ও পুলিশ বিভাগের সংস্কার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের অসংখ্য গুম-খুনের বিচারও এ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

গতকাল শুক্রবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের যে প্রথম বৈঠক হয়েছে, সেখানেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সরকারের সামনে এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

গত বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, আমাদের বোন। তাদের রক্ষা করা এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা আমাদের প্রথম কাজ। আমার ওপরে যদি ভরসা রাখেন, আশা করি দেশের কোথাও হামলা হবে না। সরকার মানুষকে রক্ষা করবে, মানুষের আস্থাভাজন হবে। সরকারি লোক দেখলে বলবে আমার লোক।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা সচল করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া সরকারি সেবাগুলো দ্রুত চালু করে প্রশাসনে চলা অস্থিরতা দ্রুত দূর করতে হবে। না হলে সরকার বিপাকে পড়বে। বিশেষ করে পুলিশ ও আমলাদের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজে লেগে যেতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো সরকারকে নিরপেক্ষভাবে সহযোগিতা করলেই কেবল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, সরকারের প্রথম কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। দেশে এখন যে হামলা, লুটতরাজ হচ্ছে, সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করা। মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনীতি ঠিক করা। অর্থনীতিতে ঠিক করতে হলে সম্পদ পাচার থামাতে হবে। সম্পদ পাচার থামানো এখন বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল আগের সরকার। সেটা দূর করতে হবে। মানুষকে মুক্তভাবে কথা বলতে দেওয়া এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দেওয়া। মানুষ হিসেবে মানুষের সম্মান ফিরিয়ে আনা।

প্রশাসনে যে দুর্নীতি ঢুকেছে, সেই দুর্নীতির তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বই হবে যত দ্রুত সম্ভব সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এত যে মানুষ মারা গেল সেই মানুষগুলো কেন মারা গেল, কারা তাদের হত্যা করল সেটা তদন্তের মাধ্যমে বের করে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। সবকিছুই একটি জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। শুধু এই আন্দোলনের সময় মৃত্যু নয়, এর আগে যে মানুষ গুম-খুন হয়েছে সেগুলোরও তদন্ত হওয়া দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অল্প সময়ের মধ্যে গুম-খুনের বিষয়ে তদন্ত করে বিচারে মুখোমুখি করতে পারবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ তো নিতে হবে। কতটা শেষ করে যেতে পারে সেটা সময় বলে দেবে।

সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা গতকাল বলেন, সরকারি কাজের আইন ও নীতিমালা আছে। এখন আইন অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। থানাসহ সর্বত্র পুলিশের উপস্থিতি দৃশ্যমান করতে হবে। পুলিশ আইন অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখলে পুলিশের ওপর আস্থা রাখবে সাধারণ মানুষ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের বছরখানেক আগে থেকে প্রশাসনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। বিশেষ করে বলপ্রয়োগের ফলে পুলিশের প্রতি ‘চরম অনাস্থা’ তৈরি হয়। সেই বলপ্রয়োগের মাত্রা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। অবশেষে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিরুদ্ধে পুলিশের বলপ্রয়োগ মাত্রা ছাড়ায়। কয়েকশ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ফলে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর প্রধান আক্রোশের শিকার হয় পুলিশ। দেশের ৪৫০টি থানা ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নিহত হন শতাধিক পুলিশ সদস্য। গতকাল সেনাবাহিনী ও বিজিবির সহায়তায় কয়েকটি থানার কার্যক্রম চালু হলেও দেশের অধিকাংশ অঞ্চলই নিরাপত্তাহীন। ফলে ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটতরাজের মতো ঘটনা বাড়ছে। এখন পুলিশ সদস্যরা যতদ্রুত সম্ভব কাজে যোগ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো যায়, তত দ্রুত পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।

রাজধানীসহ সারাদেশে আন্ডারওয়ার্ল্ডে এখন বিপুলসংখ্যক অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়া থানাগুলো থেকে কয়েক হাজার অস্ত্র লুট হয়েছে। অস্ত্র লুট হয়েছে কারাগার থেকেও। বৈধ ও অবৈধ এসব অস্ত্র উদ্ধার করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের জন্য।

পু?লিশ স্টাফ ক?লেজে কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি মো. সো?হেল রানা গতকাল বলেন, পুলিশের কাজ হচ্ছে অপরাধ প্রতিরোধ, অপরাধ তদন্ত ও অপরাধ দমন, জনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যদি কোনো কারণে আমরা মনে করি, এই বিষয়গুলো মানুষ পাচ্ছে না বা এর কোয়ালিটি ভালো নয়, তাহলে বুঝতে হবে অবশ্যই সিস্টেমে সমস্যা। সেখানে কাজ করতে হবে। অপরাধ ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে থানায় থানায় কমিউনিটি পুলিশিংয়ের নিরপেক্ষ, প্রতিনিধিত্বমূলক ও অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তা কার্যকর করা উচিত বলে পুলিশের এই কর্মকর্তা মনে করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা প্রায় এক মাসের অস্থিরতায় দেশের সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবস্থা-বাণিজ্য অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে গার্মেন্টশিল্পকে। সহিংসতার মুখে গার্মেন্ট কারখানাগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে। এখন যতদ্রুত সম্ভব এই সেক্টরে কাজের গতি স্বাভাবিক করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে না পারলে মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের অর্থনীতি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, দেশের সার্বিক অর্থনীতি এখন গতিহারা হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির সব চাকা জরুরি ভিত্তিতে সচল করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব পলিসি সংশোধন করা দরকার সেগুলো সংশোধন করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরি। সাধারণ মানুষ খুবই কষ্ট আছে। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে। তাদের কষ্ট দূর করতে যেসব উদ্যোগ দরকার, সেসব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১৫ বছরে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি দেশে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনর্গঠনে কাজ করতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দ্রুত সময়ের মধ্যে হস্তান্তর করতে পারাটাই তাদের মূল সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *