বরিশাল অফিস :: অল্প সময়ে ভালোভাবে জমি চাষের জন্য ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের বিকল্প নেই। কৃষিবান্ধব এই যন্ত্র দুটি মাটিতে চলাচল করতে সক্ষম। কিন্তু নদীপ্রধান বরিশাল বিভাগের অনেক জনপদ আছে যেখানে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার জমি চাষে অক্ষম। এমনকি আদিম পদ্ধতি গবাদিপশু দিয়েও চাষ করা সম্ভব হয় না। এবার সারা বছর জলমগ্ন এমন জমি আবাদের জন্য ভাসমান টিলার তৈরি করেছে মোস্তফা কামাল। ভাসমান টিলারকে স্থানীয়রা নাও (নৌকা) টিলার বলেও চেনেন।
বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজারের ওয়ার্কশপ মিস্ত্রি গোলাম মোস্তফার তৈরি এই কৃষিযন্ত্র ইতোমধ্যে সুখ্যাতি ছড়িয়েছে বরিশালের বাইরেও। প্রতিবছরই ১০/১২টি নাওটিলার তৈরির অর্ডার পান তিনি।
গোলাম মোস্তফা বলেন, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, পিরোজপুর ও বরিশালের বিভিন্ন এলাকা থেকে আমার বানানো টিলার কিনে নেন। প্রথমদিকে লোহা দিয়ে তৈরি করতাম। তবে এখন ক্রেতা চাহিদা আর বাজারদর বিবেচনায় প্লাস্টিক দিয়েও তৈরি করছি। যে কৃষক দিনে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে জমি আবাদ করতেন তিনি এখন এক থেকে দেড় হাজার টাকায় সমপরিমাণের জমি চাষ করতে পারছেন। ভাসমান টিলার ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করি।
তিনি আরও বলেন, আমি একসময় টিলার চালাতাম। কিন্তু নদী বিধৌত জনপদ হওয়ায় বালুমাটি, পানিতে তলানো জমি হওয়ায় অনেক জমিই চাষাবাদ করতে পারছিলাম না। আমাদের এদিকে এমন এলাকা আছে যেখানে মানুষ নামতেও পারে না আবার ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার দিয়েও চাষ করা যায় না। অথচ ওই জমিতে ধানের চমৎকার ফলন হয়। অনেককে দেখেছি বর্ষায় পানি থাকায় তাতে ট্রাক্টর বা গরু দিয়ে চাষ করতে না পারায় জমি পতিত ফেলে রেখেছেন। এ নিয়ে অনেকের অনেক আফসোস দেখেছি। আমি চিন্তা করলাম বিকল্প উপায় বের করার।
গোলাম মোস্তফা ২০১৬ সালে নিজের ওয়ার্কশপে পরীক্ষামূলক একটি টিলারের নকশা করেন। নৌকা আকৃতির টিলারটি পানিতে ভেসে থাকতে পারে যেন। এতে কোনো চাকা নেই। টিলারের ইঞ্জিন নৌকার ওপরে আর চাষের লাঙল নিচে। এতে করে পানিতে যখন চলবে তখন নৌকাটির সামনের দিক জেগে যাবে আর ইঞ্জিনসহ পেছনের দিকটা দেবে যাবে। এতে লাঙল মাটি চাষ করবে ভালোভাবে। নকশা অনুসারে তৈরি করে গোপনে নিজের জমিতে চাষ দিয়ে দেখেন উদ্ভাবিত টিলারে চাষ করা যায় কি না?
তিনি বলেন, দেখলাম চমৎকারভাবে ভাসমান টিলারটি জমি চাষ করছে। এর পর জনসম্মুখে নিয়ে আসি। মানুষও দেখে পছন্দ করেন। প্রথম বছর চারটি বিক্রি হয়েছিল। এরপর আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এখন প্রতিবছরই ১০/১২টি করে অর্ডার পাচ্ছি। আনুমানিক ৬০/৭০টি বিক্রি করেছি।
গোলাম মোস্তফার তৈরি ভাসমান টিলারের প্রথম ক্রেতা জাহিদ হোসেন বলেন, সন্ধ্যা নদীর ওপারে উজিরপুরের একটি গ্রামে জমি চাষ করছিলাম। মোস্তফার কাছ থেকে ভাসমান টিলার আনার পর সাত বছরে আমাদের বিলের জমি আর খিল (পতিত) থাকে না। ট্রাক্টরের চেয়ে এই টিলার জমির গভীরতাও তৈরি করে বেশি।
তিনি আরও বলেন, ভাসমান টিলারে চাকা না থাকায় এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পানিতে পানিতে নিয়ে যাওয়া যেমন সহজ তেমনি স্বল্প ব্যয় ও পরিশ্রমে বেশি জমি চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। শুধু আমরাই না এই টিলার নিয়ে অনেকেই তাদের জমি চাষ করছেন। এক বিঘা জমি চাষ করতে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা খরচ হত। ভাসমান টিলার কেনার পর এখন বিঘাপ্রতি এক থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ বিঘাপ্রতি আমার দুই আড়াই হাজার টাকা সাশ্রয় হয়।
আব্দুর রহিম নামের আরেক কৃষক বলেন, ঝোপ (বালুযুক্ত) মাটিতে গরু বা ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করা যায় না। নৌকা টিলার দিয়ে ভালোভাবে চাষ করা যায়। মোস্তফা এলাকার প্রয়োজন অনুসারে যন্ত্র বানিয়েছেন। যে এলাকায় যেমন যন্ত্র দরকার তা হলে কৃষকদের অনেক উপকার হয়। মোস্তফা কৃষকদের জন্য লোহার লাঙল, নৌকা তৈরি করেছেন। সম্প্রতি নদীতে চলাচল করতে পারে এমন একটি প্লেন তৈরি করেছে।
বিশারকান্দি ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নান্না তালুকদার বলেন, মোস্তফা কামালকে আমরা মোস্তফা ফিটার নামেই চিনি। তার নিজের ওয়ার্কশপ আছে। মাঝেমধ্যে অনেক কিছুই তৈরি করে। কয়েক দিন আগে নদীতে চলাচল করতে পারে এমন প্লেন তৈরি করে আলোড়ন ফেলে দেয়। আমি এটি সমর্থন করি, যদি কারও উদ্ভাবনে সাধারণ মানুষের উপকার হয় তার চেয়ে ভালো কাজ আর হতে পারে না।
বানারীপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার অনয় সিংহ বলেন, ভাসমান টিলার তৈরির বিষয়টি আমাদের জানা নেই। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব, কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানব গোলাম মোস্তফার তৈরি যন্ত্র কৃষি সহায়ক কি না। যদি কৃষি সহায়ক কোনো যন্ত্র উদ্ভাবন করেন অবশ্যই আমাদের পক্ষ থেকে তাকে সহায়তা করা হবে।