শিরোনাম

সারা বছরই মুখর থাকে ইয়ার উদ্দীন দরবার

Views: 197

পটুয়াখালী প্রতিনিধি : দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যতগুলো পুণ্যভূমি আছে, তার মধ্যে অন্যতম পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ইয়ার উদ্দীন খলিফা (র.)-এর দরবার শরিফ। সারা বছরই এই দরবার মুখর থাকে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর পদচারণে। তাদের কেউ আসেন দান কিংবা মানতের মাধ্যমে নেক মনোবাসনা পূরণের জন্য আবার কেউ আসেন স্রষ্টার নৈকট্য লাভের জন্য। পীর-মুরিদহীন ব্যতিক্রমী এই দরবারে শুধু বার্ষিক ওয়াজ-মাহফিলেই লাখো মানুষের সমাগম হয়।

মির্জাগঞ্জ দরবারে আসা দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যতগুলো দরবার বা পুণ্যভূমি আছে, তার প্রতিটিতেই একজন করে পীর থাকেন। থাকেন অসংখ্য মুরিদ বা অনুসারীও। বংশপরম্পরায় পরিবারের বড় ছেলেই পীর নির্বাচিত হন এসব দরবারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মির্জাগঞ্জ দরবার শরিফ। এই মাজারে কোনো পীর নেই, কোনো মুরিদও নেই। এ ছাড়া ধর্মীয় সব রীতিনীতি মেনেই চলে এ মাজারের সব কার্যক্রম। তাই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও এ মাজারের সুনাম রয়েছে।

আরো পড়ুন : গুঠিয়া মসজিদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইয়ার উদ্দীন খলিফা (র.)-এর প্রকৃত নাম হচ্ছে ইয়ার উদ্দীন খান। বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার নাম সরাই খান। যুবক বয়সেই তার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে মৃত্যুবরণ করেন।

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায় এসে প্রথমে মুদি ও মনোহরি পণ্য বিক্রি শুরু করেন ইয়ার উদ্দিন। এতে তাকে সাহায্য করতেন গগন মল্লিক নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি। এরপর পেশা পরিবর্তন করে পাঞ্জাবি ও টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন তিনি। এ কারণে স্থানীয়রা তাকে খলিফা উপাধি দেন। জীবিকা নির্বাহের কাজের পেছনে তিনি স্বল্প সময় ব্যয় করতেন। দিন ও রাতের সিংহভাগ সময় তিনি নামাজ ও পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ইবাদতের মগ্ন থাকতেন।

ইয়ার উদ্দীন খলিফা (র.) একজন সজ্জন ও বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তিনি সব মানুষকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন। তাই তার দোকানের কোনো পণ্য তিনি পরিমাপ করে ক্রেতাদের দিতেন না। ক্রেতারাই পরিমাপ করে পণ্য নিয়ে দাম দিয়ে যেতেন। তবে ইয়ার উদ্দীন খলিফা কবে জন্মগ্রহণ করেন ও কবে মির্জাগঞ্জে আসেন এবং কবে মৃত্যুবরণ তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি কেউই। তবে স্থানীয়দের ধারণা, ১৯২০ সালের দিকে ইয়ার উদ্দীন খলিফা (র.) মির্জাগঞ্জ আসেন এবং ১৯৩০ অথবা ১৯৩৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ইয়ার উদ্দীন খলিফা (র.)-এর দরবারে প্রতিবছর ২৪ ও ২৫ ফাল্গুন দুদিনব্যাপী বার্ষিক ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে লাখো মানুষের সমাগম হয়। এ ছাড়া প্রতিদিন এই পুণ্যভূমি দর্শন ও মাজার জিয়ারত করতে দূরদূরান্ত থেকে শত শত মানুষের আগমন ঘটে।

খুলনার পাইকগাছা থেকে চার বন্ধুর সঙ্গে মো. ওমর ফারুক (২৫) এসেছেন মির্জাগঞ্জ মরহুম ইয়ার উদ্দীন খলিফা (র.)-এর দরবারে। তিনি বলেন, এর আগেও আমি একাধিক দরবারে এসেছি। সেসব স্থানে মাহফিলে আসা মুসল্লিদের পীর তাদের মুরিদ বানান। তাদের নিজস্ব কিছু রীতি-রেওয়াজ পালনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু এখানে এ রকম কিছু নেই। এখানে শুধু কোরআন ও হাদিসের আলোকে আলোচনাই করা হয়।

তিনি আরও বলেন, অনেক দরবারে দেখেছি, বার্ষিক এসব অনুষ্ঠান কিংবা কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াও নারী-পুরুষ মিলেমিশে একাকার হয়। কিন্তু এখানের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। চাইলেই এখানে নারীরা পুরুষদের স্থানে যেতে পারেন না আর পুরুষরাও নারীদের স্থানে যেতে পারেন না। এসব কারণেই দরবারটি আমার বেশ ভালো লেগেছে। তাই পরবর্তীতেও আমি এখানে আসতে চাই।

বরিশালের উজিরপুর থেকে মানতের একটি গরু নিয়ে এ দরবারে এসেছেন পৌঢ় হামিদ গাজী। তিনি বলেন, নেক মনোবাসনা পূরণে এ দরবারে দানের জন্য যদি কেউ মানত করেন, তাহলে আল্লাহর রহমতে তার মনোবাসনা পূরণ হয়। পারিবারিক একটি সমস্যা সমাধানের জন্য এ দরবারে আমি গরু মানত করেছিলাম। আল্লাহর রহমতে আমার সেই সমস্যা সমাধান হয়েছে। তাই মাহফিলের শেষ দিন আমি মানতের গরু নিয়ে এখানে এসেছি।

টাঙ্গাইল থেকে আসা পৌঢ় আহমদ আলী বলেন, বর্তমানে সিংহভাগ দরবার ধর্মীয় নিয়মনীতি উপেক্ষা করে নিজস্ব নিয়মনীতিতে পরিচালিত হয়। কিন্তু এই ধরবারে ধর্মীয় রীতিনীতি কঠোরভাবে মেনেই সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখন পর্যন্ত সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে এই দরবার। তাই কোনো পীর-মুরিদ না থাকার পরও লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা এখানে সমবেত হন আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য।

সাড়ে আট একর জমি নিয়ে মির্জাগঞ্জ উপজেলার পায়রা নদীর তীরে অবস্থিত হজরত ইয়ার উদ্দীন খলিফা (র.)-এর দরবার শরিফ। ইয়ার উদ্দীন খলিফা (র.)-এর মাজারকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে একটি মসজিদ, একটি আলিম মাদরাসা, একটি এতিমখানা, একটি নুরানি মাদরাসা, একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

আরো পড়ুন : পটুয়াখালী থেকে অপহৃত কিশোরী যাত্রাবাড়ীতে উদ্ধার

মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদ মল্লিক বলেন, আমাদের সমাজে মাজার মানেই গানবাজনাকে বোঝায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ইয়ার উদ্দীন খলিফা (র.) মাজার ও দরবার। আমাদের প্রিয় ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে না, এমন কোনো কাজ এ মাজার ও দরবারে করা হয় না

তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় সব রীতিনীতি মেনে চলা হয় বলেই এখানের বার্ষিক মাহফিলে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। এ ছাড়া প্রতিদিন এখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী শত শত মানুষ আসেন মাজার জিয়ারত করার পাশাপাশি দান ও মানত করতে।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *