* নদীর তীরে লাশের মিছিল *৩০ লাশের গণকবরে আজও অজ্ঞাত ৯ কবর
*মেয়ে ফিরে আসার অপেক্ষায় মা * অক্ষত পবিত্র কুরআন * চারটি নৌ অগ্নিকাণ্ডে ৬৫ জনের প্রাণহানি
এস এল টি তুহিন, বরিশাল :: ২০২১ সাল ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে প্রায় ৫০০ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দ্যেশে ‘এমভি অভিযান-১০’ যাত্রা শুরু করে। ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৩ টা লঞ্চটি কেবল কীর্তনখোলা নদী পাড়ি দিয়ে সুগন্ধা নদীর পোনাবালীয়া ইউনিয়নের দেউরী এলাকায় পৌঁছেছে। যাত্রীরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যাত্রীবোঝাই চলমান লঞ্চটি আকস্মিকভাবে ইঞ্জিনরুমের ত্রুটি থেকে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগার পর লঞ্চটি সামনের দিকে যতই এগোচ্ছিল আগুনের লেলিহান শিখা ততই বাড়ছিল। শীতের এই শেষ রাতে মাঝ নদীতে বাতাসের গতিও কম ছিল না।
ঘটনার সময় অধিকাংশ যাত্রী ছিল গভীর নিদ্রায়। আগুনের কারণে যাত্রীদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় আহাজারি, আর্তনাদ। এ সময় একযোগে সকল যাত্রীর মাঝে প্রাণ বাঁচানোর প্রাণান্তকর প্রয়াস শুরু হয়ে যায়। অনন্যোপায় হয়ে অনেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়। যারা ঝাঁপ দিতে পারেনি বা সাহস করেনি তাদের অধিকাংশই আগুনে দগ্ধ হয়েছে। লঞ্চটি শেষ পর্যন্ত পুড়ে রীতিমতো কঙ্কালসার হয়েছে। যারা অনিশ্চয়তার উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দেয় তাদের কেউ কেউ সাঁতরিয়ে ক‚লে উঠতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ রয়েছে।
সেদিন দেশের ইতিহাসে ঘটে নতুন ভয়াবহ এক নৌ ট্রাজেডি। ঢাকা থেকে বরগুনা পর্যন্ত সুগন্ধা নৌরুটে লঞ্চ যাত্রার ইতিহাসে বিরল ও মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা। সুগন্ধা নদীর তীরে সারিবদ্ধ লাশ আর লাশ। আর লাশের পাশে আহাজারি ও স্বজনহারাদের আর্তনাদ। বাতাস হয়ে উঠছে ভারি, যে মেঘ আজও কাটেনি। সুগন্ধার আকাশে আজও ভাসে কান্নার শব্দ।অগ্নিকাণ্ডে ৪৯ জন নিহত হয়। নিখোঁজ হয়ে যায় অনেকে। নিহতদের মধ্যে আজও ৯ জনের মৃতদেহ শনাক্ত হয়নি। যাদের শনাক্ত হয়েছে তাদের স্বজনরাও পায়নি তেমন কোনো সহায়তা। ফলে পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে মানবেতর দিন কাটছে স্বজনদের।
ঘটনার পর অকুস্থল পরিদর্শন করেছেন নৌপ্রতিমন্ত্রী ও প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা। এ ঘটনা নিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যগণ। প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক নির্দেশে আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের লাশ দ্ররুত্ব হস্তান্তরের নির্দেশ করা হয়।
৩০ লাশের গণকবরে আজও ‘অজ্ঞাত’ ৯ কবর :- লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৯ জন নিহত হয়। সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৩০ জনের লাশ জানাজা শেষে বরগুনা পোটকাখালী এলাকায় গণকবরে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। ট্রাজেডির দ্ইু বছর পূর্ণ হলেও আজও ৯ জনের মৃতদেহ শনাক্ত হয়নি। বরগুনা জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, নিহতদের ১৯ জনের মৃতদেহ ওইদিনই হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে এবং শনাক্ত না হওয়া অজ্ঞাত ৩০ মৃতদেহ দাফন করানহয়েছিল গণকবরে। পরে স্বজনদের মধ্যে ৪৮ জনের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে অজ্ঞাত ১৪ জনের মৃতদেহের পরিচয় মিললেও এখনো পরিচয় মেলেনি ৯ মৃতদেহের। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের তালিকায় এখনো নিখোঁজের সংখ্যান৩০ এবং ৭ মৃতদেহের হদিস আজও মেলেনি।
মেয়ে ফিরে আসার অপেক্ষায় মা :- অভিযান-১০ লঞ্চে ঢাকা থেকে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা আসছিলো ফজিলা আক্তার পপি (৩০)। এখনো পপির পথ চেয়ে বসে আছেন তার মা আমেনা বেগম। অনেক খোঁজাখুজির পরেও পপির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ফজিলা আক্তার পপি পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানি ইউনিয়নের ছোট টেংরা গ্রামের আফজাল হোসেনের মেয়ে। পপির মা আমেনা বেগম জানান, ‘পপি ঢাকার সাভার এলাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েকে ঢাকায় ভালো কোন স্কুলে লেখাপড়া করাবেন সেই স্বপ্ন নিয়ে অভিযান-১০ লঞ্চে বাবার বাড়িতে ফিরছিলেন। রাত ৯টার দিকেও কথা বলেছেন তার মেয়ের সাথে। তিনি আরো বলেন, সন্তানহারা মা কিভাবে থাকে। সন্তানের অভাব কেউ পরণ করতে পারে না। খুব কষ্টে দিন পার করছি। পপি লঞ্চে ওঠার সময় ফোন দিয়া বলছিলো- মা ছুটি কম, রুটি পিঠা খাইতে মন চায়। যা খাওয়াবা জলদি খাওয়াবা। সকালে শুনি যে লঞ্চে আমার মেয়ে ছিল সেই লঞ্চেই আগুন লেগে পুড়ে গেছে। আর আমার মেয়ে আসলো না। রুটি পিঠাও খাওয়াতে পারলাম না। আমি এখন নিশ্চিত আমার মেয়ে আর নেই।’
স্বজনদের জন্য অপেক্ষা লঞ্চ ট্রাজেডির ঘটনায় প্রশাসনের তালিকায় :- নিখোঁজের সংখ্যা এখনও ৩০। তবে, সাত মৃতদেহের কোনো হদিস নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,নিখোঁজ রয়েছেন বরগুনা সদরের পরীরখাল এলাকার রাজিয়া সুলতানা ও আট বছরের শিশু নুসরাত। বছর পার হলেও এখনও মা ও বোনের মৃতদেহ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌসী। নিখোঁজ রাজিয়া
সুলতানার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসী বলেন, আমার মা ও ছোট বোন অভিযান-১০ লঞ্চে ছিলো। মা- বোনদের মৃতদেহ পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই।
মানুষ পুড়ে ছাই হয়েছে পুড়েনি পবিত্র কুরআন লঞ্চে ভয়াবহ :-:
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় সব পুড়ে গেলেও একটি কুরআন শরীফ অক্ষত পাওয়া গেছে। এমন অলৌকিক ঘটনা দেখে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ঘটনার পরদিন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঐ কুরআন শরিফটি উদ্ধার করে। এ অলৌকিক ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশ আলোচিত হয়েছে। অনেকে ছবিটিকে ফেসবুক পেজে শেয়ার এবং ছবি তুলে সংরক্ষণ করেছেন অনেকে।
চারটি নৌ অগ্নিকাণ্ডের ৬৫ জনের প্রাণহানি :- গত এক দশকে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে ঝালকাঠি ও বরগুনা নৌ-রুটে নৌ-যান ডুবির ঘটনা কমে আসলেও বেড়েছে অগ্নিকান্ডের ঘটনা। ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১ জুলাই পর্যন্ত সাড়ে ১৯ মাসে কীর্তনখোলা ও সুগন্ধা নদীতে যাত্রী এবং তেলবাহী নৌ-যানে চারটি বড়ধরনের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৬৫ জন নিহত হয়েছেন।
সূত্রমতে, ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর সকালে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে সাগর নন্দিনী-৩ নামে একটি তেলের ট্যাঙ্কারের ইঞ্জিন রুমে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ট্যাঙ্কারটির ১৩ স্টাফের মধ্যে আটজন দগ্ধ হন। ঘটনার তিনদিনে মৃত্যু হয় ছয়জনের। এ ঘটনার ৩৯ দিন পর ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী যাত্রীবাহি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর সূত্রপাতও ঘটে ইঞ্জিনরুম থেকে। ওই দূর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ৪৯ জনের। পাশাপাশি আহত ও দগ্ধ হন প্রায় শত যাত্রী। এ ঘটনার ঠিক ১৬ মাস পর চলতি বছরের ১১ মে বিকেলে কীর্তনখোলা নদীতে নোঙর করে থাকা এমটি এবাদী-১ নামে একটি তেলের ট্যাঙ্কারের ইঞ্জিন রুমে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ছয়জন নিহত হন। এই ঘটনার ঠিক ৫০ দিন পর গত ১ জুলাই দুপুরে সুগন্ধা নদীতে নোঙর করে রাখা সাগর নন্দিনী-২ ট্যাঙ্কারে বিস্ফোরণ ও পরে আগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর দুইদিন পর উদ্ধার অভিযান শেষ করার এক ঘন্টার মধ্যে গত ৩ জুলাই সন্ধ্যায় একই জাহাজে দ্বিতীয় দফায় বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আর উভয়ঘটনা মিলিয়ে মোট চারজনের মৃত্যু ও ১৯ জন গুরুত্বর আহত হন। এর আগে ২০২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর তেলবোঝাই সাগর নন্দিনী-২ ভোলার মেঘনা নদীতে অপর একটি নৌযানের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে গিয়েছিল।
ঝালকাঠিতে আজও হয়নি নৌ ফায়ার স্টেশন :- লঞ্চে আগুন লাগার খবর পেয়ে ওই সময় ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান খেয়ার ট্রলারে করে। নদীবেষ্টিত গুরুত্বপূর্ণ এ জেলায় নৌপথের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নৌ ফায়ার স্টেশন না থাকায় অভিযান-১০ লঞ্চে দ্রæত উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে এবং আগুন নেভাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। নৌ ফায়ার স্টেশন থাকলে ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি আরও কমে আসত বলে মনে করছে ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ।
গভীর রাতে মাঝ নদীতে লঞ্চে ভয়াবহ আগুন লাগলে বরিশাল থেকে নৌ ফায়ার স্টেশন ইউনিট ও ডুবুরি দল এসে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। এতে করে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। ফলে বাড়তে থাকে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি। ১৯৬৩ সালে ঝালকাঠিতে প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় শ্রেণির এই ফায়ার স্টেশনটিকে ছয় বছর আগে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করার প্রস্তাব পাঠানো হলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে এই জেলার নৌপথে অগ্নিদূর্ঘটনায় দ্ররুত্ব নির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকর করা যাচ্ছে না।
কবে হবেন নৌ-যাত্রা নিরাপদ? :- নদীমাতৃক এ দেশে অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা,যাতায়াত, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই চলছে নদীকে ঘিরে। নদী দিয়েছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ উপাধি। মানুষের যাতায়াতের জনপ্রিয় একটি মাধ্যম নৌপথ। তুলনামূলকভাবে খরচ কম এবং আরামদায়ক হওয়ায় অনেক মানুষই যাতায়াতের জন্য নৌপথকে বেছে নেন। এতকিছু সত্তে¡ও আমাদের দেশের নৌপথ কতটুকু নিরাপদ? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে একদমই ভাবতে হয় না। কিছুদিন পরপরই ছোট-বড় দুর্ঘটনাই বলে দেয় উত্তর। একটা শোকের মাতম না কাটতেই আবার দুর্ঘটনা হানা দেয়। নৌপথে নিরাপত্তার এমন বেহাল দশা চলবে কতকাল? আর কত প্রাণ হারালে সংশ্লিষ্টদের জ্ঞান ফিরবে? সর্বদা এমন প্রশ্ন জেগে উঠে যাত্রীদের হৃদয়ে। নৌপথে সংঘটিত প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে তদন্ত কমিটি হয়। নিয়ম অনুযায়ী কিছু তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনও জমা দেয়। তদন্তে উঠে আসে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কথা-অদক্ষ চালক, ত্রæটিযুক্ত ও লাইসেন্সবিহীন নৌযান, বন্দর তত্ত্বাবধায়ক ও নৌযান মালিকের দায়িত্বহীনতা এবং পর্যাপ্ত সেফটি ইকুইপমেন্টের অভাব ইত্যাদি। নৌদুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, এজন্য অভিযোগের সঙ্গে তদন্ত কমিটি কিছু সুপারিশও করে। কিন্তু এরপর এসব তদন্ত প্রতিবেদন এবং সুপারিশ কোনোটিই আলোর মুখ দেখে না।