শিরোনাম

২৩ দিনে ঝরেছে ৭শ প্রাণ

Views: 30

চন্দ্রদ্বীপ নিউজ :: শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে-পরে অর্থাৎ গত ১৬ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত চলা ২৩ দিনের সহিংসতায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্ততপক্ষে ৬৯৬ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১১৩ সদস্যও রয়েছেন। অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে গুলিতে নয়তো পিটুনিতে।

ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় লালমনিরহাটের আদিতমারী থেকে রাজধানীতে এসেছিলেন মিরাজ খান।

লালমনিরহাটের মহিষখোচা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি রাজধানীর একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন ২০ বছর বয়সী টগবগে ওই তরুণ। গত সোমবার যাত্রাবাড়ী থানার সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিল চলাকালে গুলিতে আহত হন তিনি। তিন দিন যন্ত্রণায় ভুগে বেঁচে থাকার যুদ্ধে হেরে যান মিরাজ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মৃত্যু হয় তার। এর আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।

গত সোমবার আন্দোলনকেন্দ্রিক সহিংসতায় শিক্ষার্থী মিরাজ ছাড়াও নিহত আরও ৫ জনের লাশ পাওয়া যায় গতকাল বৃহস্পতিবার। এদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একে একে ঢামেক মর্গে আনা হয় তাদের লাশ। তাদের মধ্যে উত্তরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ ২২ বছর বয়সী অচেনা এক যুবকের লাশ বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে আনেন রাজধানীর ক্রিসেন্ট হাসপাতালের এক ওয়ার্ডবয়।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইন্স হাসপাতাল থেকে দুপুর একটার দিকে আনুমানিক ৩৫ বছর ও ৩৮ বছর বয়সী অচেনা দুজনের (যাত্রাবাড়ী এলাকায় গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন তারা) লাশ ঢামেক মর্গে আনেন জনৈক হাবিব। ধারণা করা হচ্ছে, নিহত এ দুজন পুলিশের সদস্য। তারা হামলার সময় যাত্রাবাড়ী থানায় কর্মরত ছিলেন।

গত সোমবার মগবাজার ওয়ারলেস গেট এলাকায় গণপিটুনির শিকার হন ইমরান (৩৫) নামে এক যুবক। গতকাল বিকাল সোয়া ৪টার দিকে ঢামেক মর্গে আনা হয় তার লাশ।

বিভিন্ন হাসপাতাল, ভিকটিমের পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হামলা ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে-পরে (১৬ জুলাই-৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত) চলা সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে

৬ শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গত রোববার থেকে বুধবার পর্যন্ত ৩৭৭ জনের মৃত্যু হয়। আর কোটা আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ১৬ জুলাই থেকে গত রোববার পর্যন্ত মিলেছে ৩১৯ জনের লাশ। তাদের মধ্যে ১১৩ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর (র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আনসার) সদস্য রয়েছেন। বেশিরভাগই মারা গেছেন আন্দোলনকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ও পিটুনিতে। কেউ কেউ মারা গেছেন পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।

একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে গত সোমবার দুপুরে তৎকালীন সরকারপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার পথে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ সদরদপ্তর, রাজধানীর ৫০টি থানাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা এবং কোনটিতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়।

‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার পথে সংঘর্ষে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংঘর্ষ-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় রাজধানীর উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পল্লবীসহ বিভিন্ন এলাকায় গত সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত শতাধিক পুলিশসহ ২ শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য ছড়ালেও রাজধানীর ৪টি সরকারি হাসপাতালের (ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক), মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দী ও রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল) তথ্যানুযায়ী ১৭৩ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

গত সোমবার যাত্রাবাড়ী থানার মধ্যে বিক্ষুব্ধদের গণপিটুনি ও আগুনে পুড়ে ৮ পুলিশ সদস্য ও হাতকড়া পরা এক আসামির মৃত্যু হয়। সেদিন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার এই ৯ জন ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর (র‌্যাব, পুলিশ, আনসার ও বিজিবি) ১৫ সদস্যসহ ৪২ জনের লাশও আনা হয় ঢামেক মর্গে। লাশের অপেক্ষায় গতকালও নিহতের স্বজনদের ভিড় ছিল মর্গ চত্বরে। এ ছাড়া নিখোঁজ প্রিয়জনের সন্ধানে অনেকেই ভিড় করছিলেন ঢামেক মর্গে।

আন্দোলনকেন্দ্রিক ও পরবর্তী সময়ে সহিংসতায় গত সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছেন অন্তত ৩ সহস্রাধিক মানুষ। তাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ ও পিটুনিতে আহত। এদের মধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ছাড়াও পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার সদস্য, সাংবাদিক ও পথচারীরাও রয়েছেন। ঢামেক, মিটফোর্ড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কুর্মিটোলাসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গুরুতর আহত প্রায় ৫ শত নারী, পুরুষ ও শিশু। তাদের মধ্যে ঢামেকে হাসপাতালে ভর্তি ২৬৮ জন এখনো কাতরাচ্ছেন বিছানায়।

গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শিক্ষার্থী মিরাজ খানের ছোট ভাই রেজাউল ইসলাম জানান, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে কলেজে ভর্তি হয়েও ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতেন মিরাজ।

যাত্রাবাড়ী এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলেও অংশ নিয়েছিলেন মিরাজ। গত সোমবার শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে মিছিল চলাকালে গুলিতে আহত হন তিনি। প্রথমে মিরাজকে যাত্রাবাড়ীর একটি ক্লিনিকে এবং পরে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু চিকিৎসক না পাওয়ায় মঙ্গলবার সকালে ভাইকে রংপুর মেডিক্যালে নিয়ে যান রেজাউল। বুধবার সেখানে অপারেশন হলেও বৃহস্পতিবার সকালে মারা যান মিরাজ। ছেলেকে হারিয়ে মিরাজের বাবা আব্দুস সালাম বার-বার মূর্ছা যাচ্ছেন।

মিরাজের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে গ্রামে। ‘আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। শহীদ ছেলের আত্মার শান্তি কামনায় সবার দোয়া চাই’ বলেন মিরাজের বাবা।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *