শিরোনাম

শরীরে দুই শতাধিক বুলেটের যন্ত্রণা, নিভে যাচ্ছে হাবিবের দৃষ্টি

Views: 45

চন্দ্রদ্বীপ নিউজ :: রাজধানী ঢাকার খেটে খাওয়া মানুষ মো. হাবিব খান। পেশায় স্যানিটারি মিস্ত্রী হাবিব কাজের পারিশ্রমিক আনতে গিয়েছিলেন। তখনই পড়ে যান সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন দমাতে হামলে পড়া পুলিশের সামনে। দুই হাত ওপরে তুলে আকুতি করে যাচ্ছিলেন, তিনি আন্দোলনকারী নন। কিন্তু সেকথায় কান দেয়নি পুলিশ। সরাসরি ছররাগুলি ছুড়ে দেয় তাকে লক্ষ্য করে। তাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় হাবিবের শরীর।

হাসপাতালের এক্সরে রিপোর্টে দেখা গেছে, হাবিবের শরীরে দু্ই শতাধিক ছররা গুলি রয়েছে। একটি গুলি বাম চোখে বিদ্ধ হওয়ায় দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছেন হাবিব। আন্দোলন না করেও পুলিশের গুলি খাওয়া হাবিব পাঁচ হাসপাতাল ঘুরেও পাননি চিকিৎসা সেবা।

হাবিব দেশের দক্ষিণের জেলা বরগুনা সদর থানার ৭ নং ডালভাঙ্গা ইউনিয়নের মরাখালী এলাকার মান্নান খানের ছেলে। একটা সময়ে পায়েচালিত রিকশা চালালেও গত চার বছর ধরে স্যানিটারি মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করছেন। বাস করছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। সেখানেই এই চরম বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে।

রোববার (১৮ আগস্ট) সকালে মোহাম্মাদীয়া হাউজিং লিমিটেড এলাকার ২ নম্বর সড়কে হাবিবের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণশীর্ণ একটি টিনের ঘরে শুয়ে আছেন হাবিব। চার পাশে সুউচ্চ ভবনের মাঝে একটি খালি প্লটের ছাউনি ঘরে হাবিব তার দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস করেন। স্যানিটারি মিস্ত্রী হিসেবে যা আয় করতেন তাতে ভালোই চলত সংসার। কিন্তু পুলিশের হামলা আর ছররাগুলির দুই শতাধিক বুলেট তার শরীরসহ সংসারটিকেও ঝাঁঝর করে দিয়েছে। গুলি ঢুকে পড়েছিলেন তার চোখেও। যার যন্ত্রণায় তার নির্ঘুম জীবন। আর চোখের দৃষ্টিশক্তিও নিভতে বসেছে অসহায় হাবিবের। কর্মক্ষম ব্যক্তিটি বিছানায় পড়ে থাকায় বন্ধ হয়েছে আয়ের পথ। ফলে দুই শিশু সন্তানের মুখে দু-বেলা দু-মুঠো খাবার তুলে দেওয়াই এখন অনিশ্চিত। আর চিকিৎসা? ব্যয়বহুল সে চিকিৎসা পাওয়ার ভাবনা ছেড়েই দিয়েছেন হাবিব!

গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় হাবিব এই পরিস্থিতির শিকার হন। তিনি বলেন, আমি আন্দোলনে যাই নি। ঘটনার আগের দিন (১৮ জুলাই) চাঁদ উদ্যান হাউজিং এলাকার একটা বাড়িতে কাজ করি। পরের দিন কাজ ছিলো না তাই বাসায় শুয়ে ছিলাম। বিকেলের দিকে কন্ট্রাক্টর রাকিব আমাকে ফোন করে চাঁদ উদ্যান গেটে টাকা আনতে যেতে বলে। ফোন পেয়ে আমি ও আরও দুই মিস্ত্রী চাঁদ উদ্যান গেটে যাই। যাওয়ার পরে পরিস্থিতি থমথমে দেখে রাকিবকে ফোন দেই। রাকিব জানায়, চাঁদ উদ্যান গেট থেকে সে আল্লাহ করিম মসজিদের গেটে গেছে। ওখানে আমাকেও যেতে বলে। মেইন রাস্তায় আন্দোলন চলে দেখে আমরা তিনজন চাঁন মিয়া হাউজিংয়ের ভেতর দিয়ে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি যাই। এই সময়ে ওই এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিলো। তাই আমরা চাঁন মিয়া হাউজিংয়ের গেটে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন রাকিবকে ফোন দিলে সে জানায়, তার শরীরে গুলি লেগেছে। সে টাউনহলের দিকে চলে গেছে। আমার পাওনা টাকা সে পরে দিবে। এই ফোন পেয়ে আমরা যখন চলে আসবো তখন হঠাৎ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সামনে পড়ে যাই। আমি পুলিশ দেখে দুই হাত উচু করে দাঁড়াই। কিন্তু কোনো কথা না শুনেই পুলিশ আমাকে গুলি করে দেয়। তারা যে কতগুলো গুলি করেছে তার হিসাব নেই। একটা গুলিও বাইরে যায় নাই। সব আমার শরীরে লাগে।

এক চিকিৎসকের মানবিকতার কারণে বেঁচে ফিরেছেন উল্লেখ করে হাবিব বলেন, যেখানে আমাকে গুলি করা হয় তার পাশের বাসায় একজন চিকিৎসক থাকেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে কাছে আসেন। আমাকে তিনি চিনতে পারেন। বিভিন্ন সময়ে আমি তার বাসায় কাজ করেছি। তিনি আমাকে উদ্ধার করে দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান।

হাসপাতালে যাওয়ার পরে তার চেষ্টায় আমাকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু হাসপতালে ভর্তি থাকার প্রথম দুই দিন কোনো চিকিৎসা পাইনি। নাপা ছাড়া কোনো ওষুধ দেয় নাই, স্যালাইনসহ সব ওষুধ কিনে আনতে হয়েছে। দুই দিন পরে চিকিৎসা শুরু হয়। ছয়দিন চিকিৎসা নেই হাসপাতালে। এই সময়ের মধ্যে বাম চোখে গুলি লাগায় অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। পরবর্তীতে আমাকে আগারগাঁও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসা তো পেলামই না বরং অপারেশনের নামে আমার চোখটাই নষ্ট করে দিয়েছে। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ছাড়াও বেশ কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছি কিন্তু সুরাহা হয়নি। চোখের অপারেশন করাতে হবে। যার জন্য প্রায় ৮০ হাজার টাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমার সেই সামর্থ না থাকায় অপারেশন করাতে পারছি না। আর অপারেশন করালেও চোখ ঠিক হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা।

গত এক মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছেন হাবিব। শরীরে দুই শতাধিক গুলি নিয়ে বেঁচে থাকলেও যন্ত্রণায় কাটছে প্রতিটি রাত। হাবিব বলেন, রাতে ঘুমাতে পারি না। শরীরে যন্ত্রণায় উঠে বসে থাকতে হয়। সোহরাওয়ার্দীসহ কয়েকটা হাসপাতাল ঘুরে মাত্র চার থেকে পাঁচটা গুলি বের করা গেছে। আরও অন্তত ২০০ গুলি শরীরে ভেতরে রয়েছে। এই গুলির যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না। বাম চোখে দেখতে পাচ্ছি না। এখনই ভালো চিকিৎসা না করালে ডান পাশের চোখে সমস্যা হতে পারে বলে ডাক্তাররা বলেছে। কি করবো, কার কাছে যাবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

হাবিবের স্ত্রী সুখী বেগম বলেন, একটা নিরাপরাধ মানুষকে রাস্তায় পেয়ে গুলি করে দিলো। স্বামী কাজ করতে পারছে না। দুই সন্তান নিয়ে কি ভাবে চলবো? কি ভাবে চিকিৎসা চালাবো সেটাই বুঝতে পারছি না। এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্তত ৪০ হাজার টাকা ঋণ করা। অনেকেই সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও কেউ আর খোঁজ রাখে নি। আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই। না হলে আমার স্বামী অন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ তার ভালো চোখটিতেও সমস্যা হতে পারে।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *