শিরোনাম

শেরে বাংলা-জীবনানন্দের বরিশাল

Views: 122

এস এল টি তুহিন, বরিশাল : বিভিন্ন ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকে বরিশালের বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ থাকলেও এ জনপদের ভৌগোলিক উৎপত্তি নিয়ে নানা মত প্রচলিত রয়েছে। তবে বরিশাল অঞ্চলের উৎপত্তি যে প্রাগৈতিহাসিক যুগে বঙ্গোপসাগরের বুকচিরে জেগে ওঠা, এ নিয়ে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক একমত পোষণ করেছেন। বরিশাল অঞ্চলের প্রাচীন নাম বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। তবে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামের আগে এটি ‘বাঙ্গালা’ নামেও পরিচিত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, বাঙ্গালানামটি পরিবর্তিত হয়ে বাকলা হয়েছে। চতুর্দশ শতকে রাজা দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তখন চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী ছিল বাকলা।

মুঘল আমলে বাকলায় সুবে বাংলার একটি সমৃদ্ধিশালী সরকারের শাসন ছিল। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নিয়ে বাকেরগঞ্জ নামে নতুন জেলা সৃষ্টি করা হয়। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জ জেলার সদরদপ্তর বরিশাল শহরে স্থানান্তরিত করা হয়। বরিশাল নামটি অনেকটা হাল আমলের।

প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক কালের ভৌগোলিক বিবরণ: 
বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক বিবরণের পাশাপাশি চন্দ্রদ্বীপের ভৌগোলিক বিবরণ রয়েছে। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে কৌরব-পা-বদের যুদ্ধের পর ভগবান বলরাম গঙ্গার মোহনায় স্খান করেছিলেন এবং রাজসূয়া যজ্ঞের জন্য সাগর তীরের ম্লেচ্ছদের পরাজিত করে তিনি প্রচুর সম্পদ আহরণ করেছিলেন। পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারতে বাঙালিদের বা বাংলাদেশের অধিবাসীদের ম্লেচ্ছ ও দস্যু বলে অভিহিত করা হয়। রামায়ণে গঙ্গা দেবীর পাতাল প্রবেশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ সকল পৌরাণিক কাহিনী বাংলা ও বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন ভূ-তত্ত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত করে। প্রসঙ্গত মহাভারত রচিত হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। অর্থাৎ এর থেকে ধারণা করা হচ্ছে সে সময়ে এ অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল।

রাজা চন্দ্রবর্মণ চতুর্থ শতকে কোটালিপাড়ায় দুর্গ নির্মাণ করেন। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সীমান্ত থেকে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার দূরত্ব নয়-দশ কিলোমিটার। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোটালিপাড়া বাকেরগঞ্জ জেলার অধীনে ছিল। ষষ্ঠ শতকে কোটালিপাড়ায় প্রাপ্ত পাঁচটি তাম্রশাসন প্রমাণ করে মৌর্য ও গুপ্ত আমলে চন্দ্রদ্বীপ উন্নত জনপদ ছিল। ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে বরিশালের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ গৌরনদী, উজিরপুর, হিজলা ও মুলাদি থানার অধিকাংশ ভূ-গঠন প্রাগৈতিহাসিক যুগের। সিরাজ উদ্দীন আহ্মেদ তার বরিশাল বিভাগের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেন, বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ এক সময় পূর্ব সাগর বা লবণ সাগরে নিমজ্জিত ছিল।

কোনো এক অজানাকালে গঙ্গা নদীর পলি জমে সুগন্ধা নদীর বুকে সৃষ্টি হয় একটি ত্রিকোণাকার ব-দ্বীপ। ওই দ্বীপের নাম স্ত্রীকর দ্বীপ। প্রাচীন স্ত্রীকর দ্বীপ বর্তমান শিকারপুর, উজিরপুর, গৌরনদী নামে পরিচিত। মৌর্য আমলে সুগন্ধার মোহনায় বর্তমান গলাচিপা, কাঁঠালিয়া, আমতলী, এবং গুপ্ত আমলে বরগুনা, বামনা, মঠবাড়িয়া ও পাথরঘাটা নিয়ে আলাদা কয়েকটি দ্বীপের সৃষ্টি হয়। স্ত্রীকর, শঙ্খকোট, পিরোজপুর দ্বীপের সৃষ্টি হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে। পরবর্তী সময়ে এসব দ্বীপের মিলিত নাম হয় বাঙ্গালা। পাল ও সেন আমলে এ দ্বীপগুলো বাঙ্গালা ও চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল।

চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা :
রাজা রামনাথ দনুজমর্দনদেব চন্দ্রদ্বীপে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু দনুজমর্দনদেব কখন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ধারণা করেন চতুর্দশ শতকে তিনি রাজত্ব করেছেন। তবে চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের সপ্তম রাজা পরমানন্দ বসু ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে জীবিত ছিলেন। এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তিনি ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে কোটালিপাড়ায় শ্রী চৈতন্যদেবের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময়কে ধরে এক হিসাবে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন, রাজা রামনাথ দনুজমর্দনদেব ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। রাজা রামনাথ দনুজমর্দন বর্তমান বাউফল থানার কচুয়াতে রাজধানী নির্মাণ করেন। বাজধানীর নাম ছিল ‘বাঙ্গালা’। তিনি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাঙ্গালায় বন্দর নির্মাণ করেন। ওই বন্দরে আরব ও পারস্যের বণিকরা বাণিজ্য করতে আসতেন। তিনি নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছিলেন। যা প্রমাণ করে তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। পরবর্তী সময়ে চন্দ্রদ্বীপে নিজস্ব সেনাবাহিনীও ছিল।

চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন কীর্তি:
বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে প্রাগৈতিহাসিককালের কোনো কীর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়নি। চতুর্থ শতক হতে এ অঞ্চলের প্রাচীন কীর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, দীঘি, দুর্গ, তাম্রলিপি ও মুদ্রা। তবে লবণাক্ত পরিবেশ, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি ও নদীভাঙনে এলাকার অনেক কীর্র্তি বিলীন হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। আবার বিভিন্ন সময়ে মগ-পর্তুগীজসহ বহু বহিরাগত এ অঞ্চল লুটপাটের জন্য দখল করে নিয়েছিল। দখলকারীরা অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে। এরপরেও এ অঞ্চলে অসংখ্য স্থাপনা বা পুরার্কীতি রয়ে গেছে।

তেরো শতকের প্রথম ভাগের সেন বংশীয় রাজা বিশ্বরূপ সেনের একটি তাম্রশাসন পাওয়া যায় কোটালিপাড়ায়। ওই তাম্রশাসনে গৌরনদী থানার রামসিদ্ধি, বাঙ্গালা, ঝালকাঠি থানার নৈকাঠি ও চন্দ্রদ্বীপ নামের উল্লেখ আছে। হিজলা-মুলাদি থানার ইদিলপুরে কেশব সেনের একটি তাম্রলিপি পাওয়া যায়। তেরো শতকের ওই তাম্রলিপিতে ব্রাহ্মহ্মণকে ভূমি দান, চন্ডভন্ড জাতি শাসন ও মন্দির নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত মূর্তিগুলোর মধ্যে বাকেরগঞ্জের মাধবপাশা জমিদার বাড়ির কাত্যায়নী মূর্তি, শিকারপুরের তারামূর্তি ভারতবর্ষে বিখ্যাত। গৌরনদীর লক্ষণকাঠির বিষ্ণুমূর্তি বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

সুলতানী, মুঘল ও অন্যান্য আমলের প্রাচীন কীর্তি: 
চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিম স্থাপত্য শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানী আমলে বিশেষ করে ১৪৫৯ থেকে ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান রুকনউদ্দীন বরবক শাহর শাসন আমলে। এ পর্যন্ত বরবক শাহের ১৫টি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। তার নামাঙ্কিত একটি শিলালিপি পাওয়া যায় পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মসজিদবাড়িতে। মির্জাগঞ্জের মসজিদবাড়ির মসজিদ নির্মাণ হয় ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গুরিন্দা গ্রামে রয়েছে গুরিন্দা জামে মসজিদ। এ মসজিদটিও বরবক শাহের আমলে নির্মাণ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মুঘল আমলের একটি উন্নত জনপদ হিসাবে পরিচিত ছিল গৌরনদীর কসবা। ওই আমলে কসবা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক মসজিদ নির্মাণ হয়। কসবা কাজীবাড়ির সামনে একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ রয়েছে। কসবা হাটের দক্ষিণ পাশে একটি, কাহারবাড়ির কাছে একটি এবং খলিফাবাড়ির কাছে একটি মসজিদের ধ্বংসস্তূপ রয়েছে। কমলাপুর গ্রামে তিন গম্বুজ ও তিন দরজা বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে।

গুরিন্দা জামে মসজিদ:
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গলাচিপা উলানিয়া সড়কের পূর্ব পাশে গুরিন্দা খাল। ওই খালের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গুরিন্দা জামে মসজিদ। ৩৬১ বর্গফুট ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মূল মসজিদ ভবনের উচ্চতা ১৬ ফুট। এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু ভিটির ওপর। এতে রয়েছে একই মাপের তিনটি খিলান দরজা। মসজিদটির কয়েক ফুট দক্ষিণে ভিন্ন আরেকটি ভিটির ওপর ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১১ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি বৈঠকখানা রয়েছে।

ধারণা করা হয় ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বরবকশাহের রাজত্বকালে নির্মাণ করা হয় গুরিন্দা জামে মসজিদ। অবশ্য বরবকশাহের চন্দ্রদ্বীপ বিজয়ের আগেই মুসলমানদের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে। দীর্ঘদিন ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢাকা পড়েছিল গুরিন্দা জামে মসজিদ। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বাহাদুরপুরের পীর সাহেব বাদশা মিয়া এলাকায় সফরে এসে এলাকা আবাদ করে মসজিদ আবিষ্কার করেন এবং নিজে ওই মসজিদে জুমা নামাজ আদায় করেন। একই সঙ্গে মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করার জন্য এলাকাবাসীকে বলে যান। এরপর থেকে মসজিদটিতে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়।

প্রাচীন দীঘি ও পুকুর:
বিভিন্ন আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে প্রায় দুই হাজার দীঘি খনন করা হয়। এগুলোর মধ্যে মাধবপাশার দুর্গাসাগর দীঘি, পটুয়াখালীর কারখানা, বাকেরগঞ্জের কবিরাজের দীঘি, বানারীপাড়ার লস্করপুরের দীঘি, উজিরপুরের শোলকের মলুয়ার দীঘি, গৌরনদীর ছবি খাঁর পার, হিজলা থানার জমাদার বাড়ির দীঘি ও বাউফলের কমলা রানীর দীঘি আকার আয়তনের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। মূলত তৎকালীন শাসকরা এলাকার মানুষের সুপেয় পানীয়জলের প্রয়োজন মেটাতে এসব দীঘি খনন করেন। আর এসব দীঘির প্রায় প্রত্যেকটি ঘিরে মানুষের মুখে মুখে এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র কিংবদন্তি। যা ইতিহাসেরও উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বরিশালের দুর্গাসাগর দীঘি:
প্রাচ্যের ভেনিস নামে খ্যাত বরিশাল জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বানারীপাড়া সড়কের পাশে মাধবপাশার বিশাল এলাকাজুড়ে দুর্গাসাগর দীঘির অবস্থান। তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ণের মৃত্যুর পরে লক্ষ্মীনারায়ণ ১৭৭৭ খিস্টাব্দে রাজত্ব লাভ করেন। এর কিছু দিনের মধ্যে লক্ষ্মীনারায়ণের মৃত্যু হলে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে রানী দুর্গাবতী সাত লাখ টাকা রাজস্ব পরিশোধ করে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সনদ নবায়ণ করান। এ সময় তিনি সন্তানসম্ভবা ছিলেন। কিন্তু সন্তানের জন্ম না হওয়ায় দুর্গাক্রোড় নারায়ণের নামে সনদ নেওয়া হয়।

এ কারণে পরবর্তীকালে রানীর ছেলে রাজা জয়নারায়ণের আরেক নাম রাখা হয় দুর্গকুর নারায়ণ। জয়নারায়ণ শিশু থাকায় রানী দুর্গাবতী রাজ্য পরিচালনা করতেন। তৎকালীন বাংলায় যে কজন নারী রাজত্ব পরিচালনায় স্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, রানী দুর্গাবতী তাদের অন্যতম। তিনি একাধারে বুদ্ধিমতী এবং অন্যধারে প্রজাবৎসল মহিলা ছিলেন। তিনি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী শ্রীনগর বা মাধবপাশায় নিজ নামে দুর্গাসাগর দীঘি খনন করান। কথিত আছে এক রাতে রানী যতদূর হেঁটে যেতে পারেন দীঘির আয়তন ততটাই করা হয়। এতে দীঘির আয়তন ১৩ দ্রোন বা ৬১ কানিজমিতে দাঁড়ায়। দীঘি খননে কয়েক হাজার শ্রমিকের সময় লাগে পুরো ৬ মাস। শ্রমিকরা সারা দিনের কাজের শেষে পশ্চিম পাশে আরেকটি দীঘিতে কোদাল পরিষ্কার করত। এ কারণে ওই দীঘির নাম হয় কোদাল-ধোয়া দীঘি। দুর্গাসাগর দীঘি খননে খরচ হয় তিন লাখ টাকা।

রানী দীঘির চারপাশে চারটি বিশাল পাকা ঘাটও নির্মাণ করেছিলেন। দীঘির পশ্চিমে শ্রীপুর, পূর্বে কলাডেমা, উত্তরে পাংশা এবং দক্ষিণে শোলনা ও ফুলতলা গ্রাম। দুর্গাসাগর দীঘির পাশে এখনো রানী দুর্গাবতীর রাজপ্রসাদ রয়েছে। প্রায় ১০ একর জমি নিয়ে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্যতম স্মৃতিচিহ্ন হয়ে প্রসাদটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এ প্রসাদটিও দর্শনার্থীদের বেশ নজর কাড়ে। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পতনের পরে প্রায় দুই শ বছর দুর্গাসাগর দীঘি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪-৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত আগ্রহ-অনুদানে তৎকালীন ভূমি ও রাজস্বমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুর্গাসাগর দীঘির সংস্কার করা হয়। বর্তমানে এটি বরিশালের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।

বাকলার আরেক ঐতিহ্য কমলা রানীর দীঘি:
বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের অপুত্রক রাজা জয়দেব ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যাওয়ার পর সিংহাসনে আরোহণ করেন তার বড় মেয়ে কমলা সুন্দরী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী, বিদুষী এবং দৃঢ়চেতা। কমলারানী স্বাধীনভাবে দীর্ঘদিন চন্দ্রদ্বীপরাজ্য শাসন করেন। তার স্বামীর নাম ছিল বলভদ্র বসু। কথিত আছে, বলভদ্র বসু দেখতে কালো ছিলেন। তাই প্রজারা তাকে কালারাজা বলত। গলাচিপার কালারাজার বিল তার নামেই নামকরণ হয়েছে। কালারাজার বিল বর্তমানে কালারাজা গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এক সময়ে এখানে রাজপ্রসাদ ছিল।

রাজা জয়দেবের দুই মেয়ে কমলা সুন্দরী ও বিদ্যা সুন্দরী। রাজা তার দুই মেয়েকেই উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। দুই বোনের মধ্যে কমলা ছিলেন প্রতিভাময়ী। বাবার নির্দেশে তিনি রাজ্য পরিচালনা ও অস্ত্র চালনা শিক্ষা লাভ করেন। রাজ্যের শ্রেষ্ঠ প-িতদের নিকট তিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় জ্ঞান লাভ করেন। বিভিন্ন শাস্ত্রেও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। রাজা জয়দেব কমলা সুন্দরীকে বাবুগঞ্জ থানার দেহেরগতি গ্রামের উষাপতির পুত্র বলভদ্র বসুর সঙ্গে বিয়ে দেন। দেহেরগতির বসু পরিবার কৌলীন্য ও শিক্ষায় অগ্রগামী ছিল। বিদ্যোৎসাহী বলভদ্র বসু বিভিন্ন শাস্ত্রে প-িত ছিলেন। যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন বাকলা রাজ্যের মধ্যে অতুলনীয়। বলভদ্র বসুর গুণে মুগ্ধ হয়ে রাজা জয়দেব তাকে জামাতা হিসেবে গ্রহণ করেন।

বিয়ের পর রাজকুমারী কমলা দেহেরগতি চলেন যান। সেখানে কিছু দিন থাকার পর স্বামী বলভদ্র বসুসহ বাকলার রাজধানীতে ফিরে আসেন। বাবা রাজা জয়দেবের নির্দেশে তাদের জন্য নির্মিত বাড়িতে বসবাস করেন। তাদের দিনগুলো ছিল সুখকর। মৃত্যুর আগে রাজা জয়দেব কমলাকে সিংহাসনের উত্তরাধীকারী ঘোষণা করেন। ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে রাজকুমারী কমলা বাকলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বামী বলভদ্র বসু তাকে রাজকার্যে সহায়তা করতেন। রাজ্য শাসন ও প্রজা পালনে কমলা অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ওই সময় গৌড়ের সুলতান ছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্। প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য রানী কমলা রাজ্যে অনেক বড় বড় দীঘি খনন করেন। এগুলোর মধ্যে কমলার দীঘি ও বিদ্যা সুন্দরীর দীঘি অন্যতম।
রানী কমলা নিজের নামে রাজ্যে বৃহত্তম দীঘি খনন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিন দরুন ১৩ কানি অর্থাৎ একশ একর ভূমি নিয়ে দীঘি খনন করার জন্য সভাসদদের নির্দেশ দেন রানী কমলা। এক সময় দীঘি কাটা শেষ হলো। কালারাজার আত্মহত্যার কাহিনী নিয়েও বিতর্ক আছে। কারণ কমলার মৃত্যুর পর তিনি পুত্র পরমানন্দ বসুর অভিভাবক হিসাবে অনেকদিন রাজ্য শাসন করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।

রানী কমলার মৃত্যু কাহিনীও বিশ্বাস যোগ্য নয়। তবে এ কথা ঠিক যে, তিনি ওই দীঘিতে ডুবেই মারা যান। ধারণা করা হয় রানী কমলা সেদিনের ব্রাহ্মণ ও জ্যোতিষীদের অন্ধ বিশ্বাসের শিকার হয়েছিলেন। তাদের পরামর্শেই সরলমতি কমলা দীঘির মাঝখানে গিয়ে পূজা দিয়েছিলেন। খুব সম্ভব রানীর বিরোধিতাকারী একদল কর্মচারী ওই সময় দীঘির এক পাড় কেটে দেয় এবং সে স্থান দিয়ে তেঁতুলিয়া নদীর জোয়ারের স্রোত দীঘিতে ঢুকে পড়ে। সময় রানী কমলাকে উদ্ধারের জন্য কেউ কোনো চেষ্টা করেনি। কমলা পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। রানী কমলার করুণ মৃত্যু কাহিনী বাকলা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই তার মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে যায়। পরবর্তীকালে কমলার করুণ মৃত্যুকাহিনী নিয়ে রচিত হয় অজ¯্র সাহিত্যকর্ম, গান। শত বছর ধরে কমলার বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে তৈরি গান এ অঞ্চলে গীত হচ্ছে।

চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের পতন :
রাজা জয়নারায়ণকে (দুর্গাকুর) চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের শেষ রাজা বলা হয়। তবে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে জয়নারায়ণের মৃত্যুর পর রাজা নৃসিংহ নারায়ণ রাজ ক্ষমতায় আসেন। তখন চলছিল রাজপরিবারের অর্থনৈতিক ভগ্নদশা। নৃসিংহ নারায়ণের মা করুণাময়ী নৃসিংহকে অল্প বয়সেই দুটি বিয়ে করান। তার প্রথম স্ত্রীর নাম অন্নপূর্ণা ও দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম রাজেশ্বরী। নৃসিংহ নারায়ণের দুই স্ত্রীর কারোই কোনো সন্তান হয়নি। যদিও তারা একাধিক দত্তক গ্রহণ করেছিলেন। রাজা নৃসিংহ নারায়ণই চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের শেষ কর্ণধার। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চারশ বছরের প্রাচীন রাজপরিবারের দীর্ঘ ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। একদিন যারা মগ-পর্তুগীজ ও মুঘলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, আজ তাদের ঐতিহাসিক কীর্তিগুলোও নেই। শুধুমাত্র রানী দুর্গাবতীর স্মৃতিবিজড়িত দুর্গাসাগর দীঘিটি রাজপরিবারের চিহ্নহ্ন বহন করছে।

কবি বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ :
হুসেন শাহী আমলে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল। বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বিজয় গুপ্ত রচনা করেন মনসামঙ্গলবা পদ্মপুরাণ। বিজয় গুপ্ত ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের ফুল্লশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সনাতন কোটালীপাড়ার অধিবাসী ছিলেন। বাকলা অঞ্চলে সেন আমল হতে মনসার পূজা প্রচলিত ছিল। কবি বিজয় গুপ্ত দেবী মনসার ভক্ত ছিলেন। মনসামঙ্গলকাব্যের স্বপ্নাধ্যায়ে তিনি উল্লেখ করেন, মনসা দেবী কর্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে তিনি মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণকাব্য রচনা করেন। কথিত আছে কাব্য রচনার আগে তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে গৈলার মনসাবাড়ির দীঘি হতে মনসা পূজার ঘট ও কোষা উদ্ধার করেন।

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার সেই ফুল্লশ্রী গ্রাম আজও আছে। আছে ছাতিম বৃক্ষ। যার সামনেই প্রাচীন মন্দিরটি আধুনিক রূপে নির্মিত হয়েছে। কবি নিজেই মনসামঙ্গল কাব্য লেখার কারণ বর্ণনা করে লিখেছেন ।  ‘শ্রাবণ মাসের রবিবার মনসা পঞ্চমী/দ্বিতীয় প্রহর রাত্রি নিদ্রাময় স্বামী/ নিদ্রায় ব্যাকুল লোক না জাগে একজন/হেনকালে বিজয়গুপ্ত দেখিল স্বপন।’  কবি বিজয় গুপ্ত স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মনসার যে কাব্য রূপ লিখেছেন তা মনসামঙ্গল নামে পরবর্তীতে আদৃত হয়েছে। যদিও বিপ্রদাস পিপলাইসহ তৎকালীন বহু কবিই মনসামঙ্গল রচনা করেছেন, তারপরেও বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল রচনার প্রসাদগুণে অনন্য। তৎকালীন সময়ে চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশ শুধু নয়, গৈলা-আগৈলঝাড়া অঞ্চলটি প-িতনগর হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। বৈদ্যবংশীয় বহু প-িত এ সময়ে পা-িত্যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কবি নিজেই সে সময়ের সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। ‘পশ্চিমে গর্গর (ঘাঘট) নদী পূর্বের ঘন্টস্বর।

মধ্যে ফুলশ্রী গ্রাম প-িতনগর।’ মনসামঙ্গল কাব্যে রচনার সময়কাল বর্ণনায়ও কবি বিজয় গুপ্ত সাংকেতিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। ‘ঋতু শশী বেদশশী পরিমিত শক। সুলতান হোসেন রাজা নৃপতি তিলক।’ অর্থাৎ ছয় ঋতু, এক শশি (চাঁদ), চার বেদ এবং এক শশি। সে হিসেবে হয় ৬১৪১। এই সংখ্যা উল্টিয়ে লিখলে হয় ১৪১৬। স্বভাবতই ‘শক’ উল্লেখ শকাব্দ প্রচলিত। এর সঙ্গে ৭৮ যোগ করলে পাওয়া যায় খ্রিস্টাব্দ। সে হিসেবে ১৪১৬+৭৮=১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের সময়কাল। তবে কেউ কেউ এ সময়কাল সামান্য আগে পরে উল্লেখ করেছেন।

মনসামঙ্গল কাব্যের প্রাচীনত্ব যাই হোক। এর বিশেষত্ব হচ্ছে আজ দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা সুর করে মনসামঙ্গল পাঠ করে। যা এ অঞ্চলে ‘রয়ানি’ নামে বিশেষভাবে পরিচিত। মনসামঙ্গল কাব্যে গ্রামীণ জনপদের বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবন খাদ্যাভাস, জীবনযাপন, অন্তরঙ্গ সাংসারিক জীবন এমনভাবে উঠে এসেছে যা শুধু দেবী সুলভ মাহাত্ম্য নয়, আমাদের রোজকার জীবন ধারাকেই উপস্থাপন করে। তাই কাব্য নয় ‘মনসামঙ্গল’ দক্ষিণের খেটে খাওয়া মানুষের পাঁচ শতাধিক বছর আগের জীবন্ত দলিল।

আরও কিছু কীর্তি :
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাহিলারা গ্রামে রয়েছে প্রাচীন আমলের একটি মঠ। যা হিন্দু স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। মঠটি নির্মাণ করেছিলেন জনৈক রূপরাম সরকার। তিনি নবাব আলীবর্দি খানের কর্মচারী ছিলেন। মঠটি নবাবের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল। মঠের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দেবদেবির ছবি খোদিত রয়েছে। পিরোজপুরের রায়েরকাঠি গ্রামে জমিদার রুদ্রনারায়ণের নির্মিত মন্দির এ অঞ্চলের আরেক দর্শনীয় স্থান। এটি ১৭৩৭ সালে নির্মিত হয়। বরিশালের বাকেরগঞ্জের কলসকাঠি গ্রামে রয়েছে তেরোটি জমিদার বাড়ি।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *