বরিশাল অফিস:: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনে ভোটযুদ্ধের আগেই প্রার্থীদের মধ্যে চলছে জোটের মনোনয়নযুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত কে হচ্ছেন এ আসনে নৌকা প্রতীকের কান্ডারি-এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। টানা দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগের দখলে থাকা এ আসনে ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ খান মেনন এমপি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস এ আসনে প্রার্থী হওয়ায় ‘প্রার্থিতা’ নিয়ে জোটগত লড়াই শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পাঁচবারের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ খান মেননের প্রার্থিতা নিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দুবারের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস ও দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরেও তারা অস্বস্তিতে রয়েছেন।
এ ছাড়াও এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুল ইসলাম মনি ও শেরেবাংলার দৌহিত্র একে ফাইয়াজুল হক রাজু। আওয়ামী লীগ কিংবা তার শরিক দল থেকে যিনিই চূড়ান্ত প্রার্থী হবেন-তার জন্য তারা দুজনও দুশ্চিন্তা ও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবেন। মনোনয়ন প্রশ্নে জোটের আসন ভাগাভাগিতে নাটকীয় কোনো সিদ্ধান্ত হলে এ আসনে ভোটের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাবে। এ আসনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের তিন সংসদ সদস্য গত ১৫ বছরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
একসময়ের চরমপন্থি সর্বহারা ও সন্ত্রাসীদের চারণভূমি বানারীপাড়া ও উজিরপুরে গত দেড় দশক ধরে বিরাজ করছে শান্তিময় পরিবেশ। গ্রামীণ জনপদগুলো রূপ নিয়েছে শহুরে জনপদে। এসব কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ সাধারণ ভোটাররা মুখিয়ে আছেন। এখানে ওয়ার্কার্স পার্টির অবস্থান খুবই নাজুক। আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়তে চান রাশেদ খান মেনন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুসের পক্ষে একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছেন বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। তারা আওয়ামী লীগের দুর্গে পরিণত হওয়া এ আসনে দলীয় প্রার্থীর বাইরে কাউকে কোনো প্রকার ছাড় দিতে নারাজ।
গুঞ্জন রয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত একটি পক্ষ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুসকে ঠেকিয়ে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে রাশেদ খান মেননকে এ আসনে নৌকার প্রার্থী করার চেষ্টা-তদবির করছেন। শেষ পর্যন্ত সেটা হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী কারও কপাল খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা অপেক্ষায় রয়েছেন, জোটের মনোনয়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে।
তাদের অভিমত এ আসন জোটের প্রার্থী রাশেদ খান মেননকে ছেড়ে দেওয়া হলে আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিকে ঝুঁকবেন। কারণ এ আসনে জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পাটির সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক।
পূর্বের বরিশাল-২ (বাবুগঞ্জ-উজিরপুর) আসনে ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে হাতুড়ি প্রতীকে রাশেদ খান মেনন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম ফারুক অভির কাছে পরাজিত হন। এরপর তিনি আর এ আসনমুখী না হয়ে পরে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ঢাকা-৮ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মেনন এবার বরিশাল-২ ও বরিশাল-৩ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদি) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। এবারও তিনি প্রার্থী হয়েছেন। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বাবুগঞ্জের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার খালেদ হোসেন স্বপন। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি দুদলই নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। মেনন ছাড়াও এ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ মো. টিপু সুলতান।
অন্যদিকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংশোধিত বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. মনিরুল ইসলাম মনি, দশম সংসদ নির্বাচনে অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে মো. শাহে আলম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও প্রথমে অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন ভাগাভাগিতে মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছিলেন ইউনুস। তখন এ আসনে প্রথমে জাপার প্রার্থী চলচ্চিত্র অভিনেতা মাসুদ পারভেজ সোহেল রানাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে বিদ্যুৎ বিল খেলাপিতে হওয়ার কারণে তার মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। ফলে শেষ মুহূর্তে নৌকার টিকেট পেয়ে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য হন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. শাহে আলম। এবার তিনি মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন।
বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাওলাদ হোসেন সানা বলেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস একজন জনদরদী, নির্মোহ ও ক্লিন ইমেজের কর্মীবান্ধব নেতা। তার বিজয় নিশ্চিত করতে আমরা একাট্টা হয়ে কাজ করছি। তাকে ঘিরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক আবেগ ও উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। নবরূপে তারা উজ্জীবিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রতিটি কেন্দ্র কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ আসন আওয়ামী লীগের দুর্গ। দলকে বাঁচাতে তার বিকল্প নেই।
ওয়ার্কার্স পার্টির উজিরপুর উপজেলা শাখার সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান সীমা রানী শীল বলেন, ১৪ দলীয় জোট রাশেদ খান মেননকে এ আসনে মনোনয়ন দিলে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।
বানারীপাড়া উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মিজানুর রহমান চোকদার বলেন, এ আসন একসময় আমাদের দখলে ছিল। জাতীয় পাটির প্রার্থী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপসকে এ আসন ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি বিজয়ী হবেন-এটা সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রার্থী প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী নকুল কুমার বিশ্বাসের বিজয় নিয়েও তার কর্মী-সমর্থক ও ভক্ত-অনুরাগীরা স্বপ্নের জাল বুনছেন। প্রসঙ্গত, বরিশাল-২ আসনে মোট ১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। যাচাই-বাছাইতে দুই প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে।