শিরোনাম

দক্ষিণাঞ্চলের সংখ্যালঘুদের কাছে ৫২ বছর পর স্বস্তির নির্বাচন

Views: 45

এস এল টি তুহিন, বরিশাল : স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে ৫৩ বছরে পর্দাপন করে এবারই জামায়াত-বিএনপির আতঙ্ক বিহীন উৎসব মুখর পরিবেশে স্বস্তির নির্বাচন পেতে যাচ্ছেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী ও পুরুষরা। ফলে সর্বস্তরের ভোটারদের মাঝে নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দিপনার সৃষ্টি হয়েছে। যেকারণে বিগত ১৫ বছরে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন (৭ জানুয়ারি) ভোটকেন্দ্রে সর্বাধিক সংখ্যক ভোটার উপস্থিত হওয়ার আশা করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

এর আগে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের প্রতিটি নির্বাচন আসলেই সংখ্যালঘু ভোটারদের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করতো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের ২১টি আসনে প্রতিদ্বন্ধিতা করা ১১৯ জন প্রার্থী নিজেদের পক্ষে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি বিশেষ করে, ৭ জানুয়ারি নির্বিঘেœ ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের কাছে অনুরোধ করছেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করা প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ব্যতিক্রমধর্মী প্রচার-প্রচারনায় এবার ভিন্নতা প্রকাশ পাওয়ায় মহাখুশি সাধারণ ভোটাররা।

ফলশ্রুতিতে এবার প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারনা ও গণসংযোগে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নির্বাচনী মাঠে নারী ভোটারদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।

পাশাপাশি অতীতের জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এবার সর্বাধিক সংখ্যক ভোটার উপস্থিত করার জন্য প্রতিটি আসনে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ভোট কেন্দ্র কমিটি গঠণ করা হয়েছে।

ফিরে দেখা বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন ॥ ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ধর্ষণের শিকার বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বিল্লগ্রামের বাসিন্দা এক গৃহবধু বলেন, পাশ্ববিক নির্যাতনের পর প্রত্যেকবার নির্বাচন আসলেই আতঙ্কে থাকতাম, এবারও বুঝি আর রেহাই মিলবেনা। কিন্তু এবারের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত অংশগ্রহণ না করায় আমার মতো নির্যাতিতদের মধ্যে আতঙ্ক নেই।

সূত্রমতে, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর পরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। ওই নির্বাচনের পর অন্ধকার যুগ দেখেছিল বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসী। এরমধ্যে বরিশাল-১ আসনের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলার আওয়ামী লীগ সমর্থিত নেতাকর্মীসহ সংখ্যালঘু সস্প্রদায়ের লোকজনের নির্যাতনের নির্মম কাহিনি ছিলো বিশ্বব্যাপী আলোচিত। সূত্রে আরও জানা গেছে, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের ক্যাডার বাহিনীর হাতে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ধানডোবা গ্রামের ৩০টি, বিল্লগ্রামের ২৫টি, চাঁদশী গ্রামের ২০টি, খাঞ্জাপুর গ্রামের ১৫টি, ইল্লা গ্রামের পাঁচটি, গেরাকুল গ্রামের পাঁচটি ও আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের ৫০টি, রামানন্দেরআঁক গ্রামের ২৫টি, বাহাদুরপুর গ্রামের ৩০টি, বাকাল গ্রামের ২৫টি, পতিহার গ্রামের ৩০টিসহ কয়েকশ’ পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এ ছাড়া জোট ক্যাডারদের হিং¯্র থাবা থেকে এসব এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবারের তরুনী, যুবতী ও গৃহবধূদের রক্ষা করতে অধিকাংশ পরিবার গোপনে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। যারা বাড়িতে ছিলেন বিএনপি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তাদের রক্ষার জন্য পরিবারের সদস্যরা রাতের আধাঁরে কলাগাছের ভেলা বানিয়ে নির্জন পুকুর কিংবা দিঘীর মাঝে রেখেও রেহাই পায়নি। ওইসময় গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার বিভিন্ন গ্রামের অসংখ্য পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ নির্বাচনী এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার দুর্গম রামশীল গ্রামে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলো। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা আগৈলঝাড়ার বাশাইলের ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন মোল্লাকে প্রকাশ্যে অপহরণ করে হত্যা করে। এ ছাড়া সরকারি গৌরনদী কলেজ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক সফিকুল ইসলাম বুলেটকে গৌরনদী বন্দরে বসে প্রকাশ্য দিবালোকে ইট দিয়ে পিটিয়ে ও বরিশাল নগরীর আমানতগঞ্জ এলাকার ছাত্রলীগ নেতা মাসুম সিকদারকে কুপিয়ে হত্যা করে। ওইসময় দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় নির্যাতনের ঘটনা ধারাবাহিক প্রচারে জোট সরকার শুরুতেই বড় ধরনের হোঁচট খায়। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের অসংখ্য ঘটনা ঘটলেও থানায় কোনো মামলা করতে পারেনি নির্যাতিতরা। পরবর্তীতে কয়েকটি আলোচিত ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হলেও তৎকালীন সময়কার সাংসদদের চাঁপের মুখে থানা পুলিশ দায়সারাভাবে আদালতে চার্জশিট দাখিল করায় হত্যার ঘটনাও মিথ্যে প্রমানিত হয়। ফলে অভিযুক্ত আসামিরা সবাই খালাস পেয়ে যায়। সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরেরদিন সকাল থেকেই গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে হামলা চালায় বিএনপির সন্ত্রাসীরা। তাদের অমানুষিক নির্যাতনে অসংখ্য পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।

গৌরনদী উপজেলার বিল্লগ্রামের ধর্ষণের শিকার এক নারী জানান, তিনি গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি কালিয়া দমন গুহর রাইস মিলে কাজ করতেন। নির্বাচনের পর বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা চাঁদার দাবিতে মিলটি বন্ধ করে দেয়। কয়েকদিন পর মিলটি চালু করতে গেলে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। স্থানীয়রা মুমূর্ষ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করে। নির্যাতিত ওই নারী বলেন, পুলিশ তখন তার জবানবন্দি রেকর্ডসহ ধর্ষণের আলামত উদ্ধার করলেও আইনগত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। বিএনপি সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরন করা আগৈলঝাড়া উপজেলার সুতারবাড়ি গ্রামের সঞ্জীব জানান, নির্বাচনের পর তার বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে। একপর্যায়ে তাকে ও পরিবারের নারী ও শিশুদের গাছের সাথে বেঁধে পিটিয়ে আহত করে।

চাঁদশী গ্রামের নির্যাতিত কৃষ্ণ কান্ত দে বলেন, ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর বিএনপির সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত তাদের গ্রামটিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা হামলা চালিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারীদের ধর্ষণ করে। কৃষ্ণ কান্ত আরও বলেন, হামলার পরেরদিন তিনি তার ছোট ভাইকে নিয়ে বোরকা পরে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে পাশের রামশীল গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইল্লা গ্রামের নির্যাতিত প্রণব রঞ্জন দত্ত বাবু জানান, বিএনপির সন্ত্রাসীরা তাকে না পেয়ে তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে কুপিয়ে জখম করে বাড়িতে লুটপাট চালায়। পরেরদিন রান্না করে খাবার মতো কোনো হাঁড়ি-পাতিলও ঘরে রেখে যায়নি সন্ত্রাসীরা। হামলাকারীরা তাদের বাড়ির মন্দিরেও অগ্নিসংযোগ করেছিলো।

রেহাই পায়নি লর্ড হার্ডিঞ্জের আট বছরের শিশু ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের অত্যাচারকে হার মানিয়ে নতুন করে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছে ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট ক্যাডারদের নির্মম নির্যাতনের কাহিনী। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরেরদিন বরিশাল বিভাগের দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চর অন্নদাপ্রসাদ, পিয়ারীমোহন ও ফাতেমাবাদ গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায় ওই এলাকার বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা।

হামলা থেকে বাঁচতে ভেন্ডারবাড়ী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীরা। বিএনপির সন্ত্রাসীরা সেখানেও হানা দিয়ে রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত নিপীড়ন ও লুটপাট চালায়। সেইদিন বিএনপির সন্ত্রাসীদের কু-নজরে চর অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের আট বছরের যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছিল সে এখন আর বাড়িতে থাকেনা। বাড়িতে থাকা তারা বৃদ্ধা ঠাকুরমা বলেন, সেইদিনের কালিমার কথা তারা কোনদিন ভুলতে পারবেন না। নির্বাচনের পরেরদিন ২ অক্টোবর অন্নদাপ্রসাদ গ্রামসহ পাশ্ববর্তী গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীরা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেঁছে নিয়েছিল গ্রামের চারপাশের ধানক্ষেত ও জলাভূমি পরিবেষ্টিত ভেন্ডারবাড়ী। অর্ধশতাধিক নারী তাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলো। কিন্তু সে বাড়িটিও সন্ত্রাসীদের নজর এড়ায়নি। শত শত বিএনপির সন্ত্রাসীরা ৮/১০টি দলে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে ওই রাতে হামলা চালায়। একের পর এক দল হামলা চালিয়ে অসহায় হিন্দু পরিবারের মেয়েদের ধর্ষণ করতে থাকে। শত চেষ্টা করেও নারীরা তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি। সেদিন আট বছরের এক শিশু কন্যা, মা, মেয়ে, শাশুড়ি, পুত্রবধূকে ধর্ষণ করা হয় একসাথে। ওইসময় ছেলের চেয়েও ছোট বয়সের সন্ত্রাসীরা ধর্ষণ করে মায়ের চেয়েও বেশি বয়সের নারীকে। সন্ত্রাসীরা ছাড়েনি এক পঙ্গু নারীকেও। সন্ত্রাসীদের পাশবিক অত্যাচারের একপর্যায়ে ওই পঙ্গু নারী জ্ঞান শুন্য হয়ে পরে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলেন। সন্ত্রাসীদের তান্ডবে পালাতে গিয়ে অন্তঃস্বত্বা এক মা বাধ্য হয়ে ধানক্ষেতেই সন্তান প্রসব করছিলো। পরবর্তীতে সম্ভ্রম হারিয়ে অনেকেই লোকলজ্জায় দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন।

সেদিনকার নির্যাতিত (বর্তমানে গৌরনদীর মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান) সৈকত গুহ পিকলু বলেন, কি নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসীরা নির্যাতন চালিয়েছে তা বলে বোঝানো যাবেনা। ওদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের একপর্যায়ে পরিবারের সদস্যদের অনুরোধ পালাতে গিয়ে ধরা পরে যাই। পরে ওরা আমাকে একটি স্কুলের কক্ষে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে। একপর্যায়ে আমি পানি পানি করে চিৎকার করলে ওরা প্রকাশ্যে প্রসাব করে আমাকে খাইয়েছে।

এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিহিংসার রাজনীতিকে বিশ্বাস করেন না। তাই আমরা টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও সেইদিনের লোকহর্ষক ঘটনার কোন প্রতিবাদ করিনি।

আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ আরও বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে আর কোনদিন ২০০১ সাল আসবেনা। এজন্য সর্বস্তরের ভোটারদের বিবেককে জাগ্রত করে আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য তিনি আহবান করেছেন।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *