এস এল টি তুহিন,বরিশাল :: চলমান শৈত্য প্রবাহ ও ঘন কুয়াশা সহ একের পর এক বৈরী আবহাওয়ায় মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক ও কৃষি অর্থনীতি। বোরো বীজতলা, গোলআলু, গম ও শীতকালীন সবজি মারাত্মক সংকটের মুখে। চলমান শৈত্য প্রবাহ বোরো বীজতলায় ‘কোল্ড ইনজুরী’, গোল আলুর জন্য ‘লেট ব্লাইট ডিজিজ’ এবং গমের জন্য ছত্রাকবাহী ‘ব্লাস্ট’ সংক্রমন সহ সবজি ফসলে ঘনকুয়াশা ও শীতের বিরুপ প্রভাবে গুনগত মান বিনষ্ট হচ্ছে। গত অক্টোবরে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় হামুনের পরে নভেম্বরে আরেক ঝড় ‘মিধিলি’ দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল আমনের উৎপাদনে যথেষ্ট বিরুপ প্রভাব ফেলে।
পরপর দুই মাসের ওই দুটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল বর্ষণে থোর এবং আধাপাকা আমনের বিপুল জমি প্লাবিত হওয়ায় উৎপাদন যেমন ব্যাহত হয় তেমনি শীতকালীন সবজি সহ অন্যান্য রবি ফসলের আবাদকে অনেকটা বিলম্বিত করে। এখন আবাদকৃত রবি ফসল নতুন দুর্যোগের কবলে। বিগত বছরগুলোতে যেখানে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই গম, গোল আলু ও পেঁয়াজের আবাদ সম্পন্ন হতো এবার তা মধ্য জানুয়ারী পেড়িয়েও অব্যাহত আছে অক্টোবর-নভেম্বরের অকাল বর্ষণের কারণে। ফলে ওই সব ফসলের উৎপাদন ও গুণগতমান ব্যাহত হওয়ারও সম্ভাবনা বাড়ছে।এর উপরে অগ্রহায়ণের বর্ষণ সব ফসলের জন্যই যথেষ্ট বিরুপ পরিস্থিতি তৈরী করে।
বর্ষায় বৃষ্টির আকালের পরে হেমন্তের অতি বর্ষণ ও অকাল বর্ষণের ধকল কাটিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিযোদ্ধারা শীতকালীন সবজি, বোরো, গোল আলু, গম ও পেঁয়াজ সহ অন্যান্য ফসল আবাদে লক্ষ্য অর্জনে মাঠে থাকলেও কুয়াশার সাথে শীতের দাপট সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। পৌষের শেষভাগ থেকে ঘন কুয়াশার সাথে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের নিচে নামার পরে মাঘের প্রথম দিন, ১৫ জানুয়ারী বরিশালে তাপমাত্রার পারদ দেশের সর্বনিম্ন, ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে যায়। যা ছিল স্বাভাবিকের ২.৯ ডিগ্রী নিচে। সাথে ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়া পরিস্থিতিকে আরো বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছে। বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ১৪ জানুয়ারী ১০.৫, ১৩ জানুয়ারী ১০.৭ ডিগ্রীতে নেমে যায়। প্রায় ৪৮ ঘন্টা পরে সোমবার সকালে বরিশালে সূর্যের দেখা মিললেও মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১টার আগে রোদে চোখে পড়েনি।
চলতি রবি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ১৭ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদনের লক্ষ্যে ৪ লাখ হেক্টরে আবাদের জন্য যে বীজতলা তৈরী হয়েছে, তা ‘কোল্ড ইনজুরী’র কবলে।অপরদিকে ১৫ লাখ টন সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে যে প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টরে শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে সেখানেও থাবা বসিয়েছে প্রতিকূল আবহাওয়া পরিস্থিতি। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়া সহ শৈত্য প্রবাহের কনকনে ঠান্ডায় ফুল কপি ও বাধা কপি সহ বিভিন্ন সবজির উৎপাদন ব্যাহত হবার পাশাপাশি গুণগত মানও বিনষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার টন উৎপাদনের লক্ষ্যে চলতি রবি মৌসুমে যে প্রায় ৬০ হাজার হেক্টরে গম আবাদ হয়েছে তাও ঝুঁকির মুখে ছত্রাকবাহী ‘ব্লাষ্ট’ রোগের শংকায়। বর্তমান জলবায়ু পরিস্থিতি সহ আগামী দু-একদিনের মধ্যে বৃষ্টির যে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ, তা ব্লাষ্ট সংক্রমনের উপযোগী বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা।
অপরদিকে চলতি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে প্রায় ১২ হাজার হেক্টরে ৩ লাখ টন গোল আলু উৎপাদনের লক্ষে আবাদ শেষ পর্যায়ে থাকলেও ঘন কুয়াশার সাথে শৈত্য প্রবাহ অব্যাহত থাকায় সেই ফসল ‘লেট ব্লাইট’ নামে এক ধরনের ছত্রাকবাহী রোগের সংক্রমন নিয়ে শংকিত কৃষকরা।
এমনকি অক্টোবর ও নভেম্বরে দু দফার অকাল ও প্রবল বর্ষণের কারণে পেঁয়াজের আবাদও অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। চলতি মৌসুমে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলার প্রায় ৯৩ হাজার হেক্টরে ১১ লাখ ৮২ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির রয়েছে। দেশে উৎপাদিত মোট পেঁয়াজের প্রায় ৩৩ শতাংশই উৎপাদন হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে। গত বছর দেশে উৎপাদিত ৩৪.১৬ লাখ টন পেঁয়াজের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলেই সাড়ে ১১ লাখ টনেরও বেশী উৎপাদন হয়েছিল বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা জানান, আমরা পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষনিক নজর রাখছি। প্রতিটি এলাকার ব্লক সুপারভাইজারদের পরিস্থিতি বুঝে কৃষকদের যথাযথ পরামর্শ প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি ব্লক সুপারভাইজারদের কাজ নিয়মিত মনিটরিং করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।