এস এল টি তুহিন, বরিশাল:: যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন সন্তানসম্ভবা শাবনুর আক্তার। তার স্বামী হৃদয় মিয়া কী করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে শাবনুরের শাশুড়ি খোদেজা বেগম তার পুত্রবধূকে নিকটস্থ পশ্চিম বেজহার কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে দায়িত্বরত কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) গায়ত্রী রানী পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, শাবনুরের এটি প্রসবব্যাথা নয়; এটি গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা। এরপর তিনি শাবনুরকে কিছু ওষুধ দিয়ে বাড়ি যেতে বলেন। সেই ওষুধ খাওয়ার পরেই শাবনুরের ব্যাথা কমে আসে।
ঘটনাটি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পশ্চিম বেজহার গ্রামের। গ্রামের অসংখ্য নারী গর্ভকালীন বিভিন্ন ধরনের ব্যাথাকে প্রসবব্যাথা বলে মনে করলেও আসলে তা প্রসবব্যাথা নয়। তা ফল্স পেইন। যেমনটি শাবনুরের বেলায় ঘটেছে। এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি কমিউনিটি ক্লিনিকেও স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দেওয়া হচ্ছে। সেইদিনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে শাবনুর আক্তার বলেন, সাধারণত কোন হাসপাতাল কিংবা বেসরকারি ক্লিনিকে যেকোন সমস্যা নিয়ে গেলে প্রথমেই চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরীক্ষার করাতে দিয়ে থাকেন। ওই পরীক্ষা করাতে গিয়েই রোগী প্রথমপর্যায়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। এরপর চিকিৎসকদের ভিজিট দেওয়ার পরে দেখা যায় সাধারণ রোগীরা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধই ক্রয় করতে পারছেন না। সেখানে পুরোটাই উল্টোচিত্র কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে। এখান থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আমরা যেকোন ধরনের সাধারণ রোগের চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ পাচ্ছি। অথচ কিছুদিন পূর্বেও ছোটখাটো রোগের চিকিৎসা নিতে উপজেলা সদরের সরকারি হাসপাতাল কিংবা বেসরকারি ক্লিনিককে যেতে হতো। যা এখন আর লাগে না। বর্তমানে হাতের কাছে ও ঘরের পাশে স্মার্ট কমিউনিটি ক্লিনিক বদলে দিয়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির স্বাস্থসেবার মান। প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপথে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়ে অসহায় সাধারণ মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে স্বস্তি। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় যে উন্নতি সাধন করেছে, তাতে কমিউনিটি ক্লিনিকের বড় ভূমিকা রয়েছে।
ভীমেরপাড় কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা অন্তঃসত্ত্বা মাসুদা বেগম বলেন, এ ক্লিনিকটি থাকায় আমরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাচ্ছি। একইসাথে আমাদের বেশ কয়েক ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। যারমধ্যে রয়েছে ৩০টি আয়রন ট্যাবলেট, ৩০টি ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ট্যাবলেট ও ৩০টি ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট। মাসুদা বেগম আরও বলেন, আমার স্বামী দিনমজুর। সংসারে অর্থ কষ্ট রয়েছে। সন্তান প্রসব নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। বিনামূল্যে ওষুধ ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়ে বর্তমানে আমরা অনেকটা চিন্তা মুক্ত হয়েছি।
পশ্চিম বেজহার কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি গায়ত্রী রানী ও ভীমেরপাড় কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি আশীষ কুমার বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে মাতৃত্বকালীন পাঁচটি বিপদের আশঙ্কা, গর্ভবর্তী মায়ের স্বাস্থ্যসেবা, প্রসূতি মায়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা এবং মা ও শিশুর শারীরিক যত্নসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন গ্রামীণ জনপথের নারীরা। সিএইচসিপি গায়ত্রী রানী বলেন, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ জন করে রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।
এরমধ্যে সাধারণ রোগী সেবা, বাচ্চাদের শুন্য থেকে পাঁচবছর পর্যন্ত সেবা, গর্ভবতী মায়েদের ডেলিভারী সেবাসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা সেবা রয়েছে। সিএইচসিপি আশীষ কুমার বলেন, বর্তমানে বিনামূল্যে ২৭ প্রকারের ওষুধ বিতরণ করা হয়। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত এসব স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হচ্ছে। আর রোগীর উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি সবধরনের পরামর্শমুলক স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী প্রত্যেকে ন্যূনতম তিন দিন কমিউনিটি ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবাদান করেন। তিনি আরও বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকে গ্রামীণ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বিনামূল্যে স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দেওয়া হয়। ক্লিনিকের নারীরা প্রসবপূর্ব (গর্ভকালীন), প্রসবকালীন ও প্রসব-উত্তর (প্রসবের পরবর্তী ৪২ দিন) অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদান করেন। সদ্য প্রসূতি মা (ছয় সপ্তাহের মধ্যে) এবং শিশুদের (বিশেষত মারাত্মক পুষ্টিহীন, দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া ও হামে আক্রান্ত) ভিটামিন-‘এ’ ক্যাপসুল প্রদান করা হয়। এছাড়াও নারী ও কিশোরীদের রক্তশূন্যতা চিহ্নিত করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ দেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে শিশুদের প্রতিষেধক এবং ১৫-৪০ বছর বয়সী নারীদের ধনুষ্টংকারের টিকা দেওয়াসহ ১৫ বছরের কম বয়সের শিশুদের মধ্যে সন্দেহজনক এএফপি (হাত-পা বা যেকোনো অঙ্গ হঠাৎ অবশ হওয়া বা দুর্বল হওয়া) শনাক্ত করার পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
নবজাতকের অত্যাবশ্যকীয় সেবাদানসহ আগ্রহী নারীদের আই.ইউ.ডি স্থাপন, প্রথম ডোজ গর্ভনিরোধক ইনজেকশন প্রদান এবং জন্মনিরোধকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ সংকট, বেতন বন্ধসহ প্রজেক্টের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে কাজ করা সিএইচসিপিসহ অন্যান্যরা প্রতিনিয়ত চাকরির অনিশ্চয়তার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ব্যাপক কাজ করছে। বিশেষ করে প্রত্যন্তগ্রামাঞ্চলের সবার কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রধান ভূমিকা রাখছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম এই উদ্যোগ গ্রামাঞ্চলে এখন ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। ক্লিনিকগুলোতে আন্তরিক পরিবেশে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সম্পূর্ণ সরকারিভাবে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নত করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সূত্রমতে, সম্প্রতি সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বরিশালের বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করেছেন। ওইসময় তিনি কমিউনিটি গ্রুপ ও কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের নিয়মিত সভা আয়োজন বিষয়ক ওরিয়েন্টেশন কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কর্মীদের নানা দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
পরবর্তীতে তিনি বরিশাল বিভাগের সকল সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময়কালে বলেছিলেন, স্মার্ট কমিউনিটি ক্লিনিক হচ্ছে প্রান্তিক জনগণকে স্মার্ট করা। আমাদের মূল পিলার হচ্ছে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। যিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পর এবার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ব্রত গ্রহণ করেছেন।
সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী আরও বলেছেন, বিশ্বের অনেক দেশই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেখানো পথে কমিউনিটি ক্লিনিকের আদলে তাদের নিজ নিজ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্টির জন্য স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীদের ক্ষমাতয়ন করেছেন উল্লেখ করে ডাঃ মোদাচ্ছের আলী বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীদেরও কমিউনিটি ক্লিনিকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এতে করে নারীরা একদিকে যেমন অর্থ উর্পাজন করতে সক্ষম হয়েছেন, তেমনি ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সম্মানিত হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বরিশাল জেলার ১০টি উপজেলার ২৭৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সর্বমোট প্রায় ৩ লাখ ৬৩ হাজার পুরুষ, ৮ লাখ ৫ হাজার নারী এবং ৯০ হাজার ৩শ’ শিশুকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানসহ বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পরিবার-পরিকল্পনা ও পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশে অন্তঃস্বত্ত্বা মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস পেয়ে মানুষের গড় আয়ুবৃদ্ধি পেয়েছে। সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলার সদ্য সাবেক সভাপতি প্রফেসর শাহ্ সাজেদা বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের সুফল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ায় ঝাড়-ফোক-তাবিজ-কবিরাজি ইত্যাদি অপচিকিৎসা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামের মানুষ এখন বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে অবহেলিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে।
বরিশাল জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মারিয়া হাসান বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা নারী ও শিশু রোগীর সংখ্যা বেশি। এসব রোগীরা মুলত গর্ভবর্তী মায়ের স্বাস্থ্যসেবা, শিশু স্বাস্থ্য ও সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসেন। বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ পেয়ে সাধারণ মানুষ খুব খুশি। গ্রামীণ জনপদের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় মানসসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের ছয়টি জেলার ৪২টি উপজেলার ৩৫২টি ইউনিয়নের পল্লী অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। বরিশাল, ঝালকাঠী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শতভাগ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করেছে এক হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের এখন আর অপচিকিৎসার শিকার হয়ে অকালে প্রাণ দিতে হচ্ছেনা। তাই এ অঞ্চলের প্রায় এক কোটি বাসিন্দাদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রথমস্থান হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক।
সূত্রে আরও জানা গেছে, বিভাগের ছয় জেলায় বর্তমানে ১ হাজার ৩১টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এরমধ্যে বরিশালে ২৭৫টি, ভোলায় ২১১টি, পটুয়াখালীতে ১৮৪টি, পিরোজপুরে ১৫৪টি, বরগুনায় ১২০টি ও ঝালকাঠীতে ৮৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এ ছাড়া বিভাগের জন্য আরো ১২৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হবে বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছেন।