শিরোনাম

বরিশালে তেল বীজ উৎপাদন ও মধু সংগ্রহে আগ্রহী যুবকরা

Views: 67

বরিশাল অফিস :: বরিশালে চলতি রবি মৌসুমে সোয়া দুই লাখ টন বিভিন্ন ভোজ্য তেল জাতীয় ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রায় দেড় লাখ হেক্টরে আবাদ সম্পন্ন শেষ পর্যায়ে। এরমধ্যে সরিষা, সয়াবিন, চিনাবাদাম, তিল ছাড়াও সূর্যমুখী রয়েছে। আর সরিষার সাথে মধু উৎপাদনেও বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় নতুন কিছু উদ্যোগ বেকার যুবকদের আকৃষ্ট করছে। বরিশালে মধু উৎপাদনে সুদূর টাঙ্গাইল থেকে দুই ভাই ছুটে এসছেন। এখন সারাদেশে উৎপাদিত সয়াবিনের ৩৫ ভাগেরও বেশী বরিশাল অঞ্চলে আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া চিনা বাদামের প্রায় ২০ভাগ, তিল এর অর্ধেক এবং সূর্যমুখীর প্রায় ৪৮ ভাগের আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে।

টাঙ্গাইলের গোপালপুরের হেমনগর ইউনিয়নের নতুন সিমলা পাড়ার বাসিন্দা মোঃ আয়নাল স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পেরে অতি সম্প্রতি বাবুগঞ্জের রাকুদিয়াতে ছুটে এসেছেন সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করতে। তার ছোট ভাই মো. মুন্না খান প্রশিক্ষিত মৌচাষী। আয়নাল জানান, রাকুদিয়ায় তাদের খামারে ইতোমধ্যে ১০৫টি মৌমাছির বাক্স স্থাপন করেছেন। খামারে একটি করে রাণী মৌ-মাছি প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার ডিম দেয়। ফলে প্রতিদিনই মৌমাছির সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি সপ্তাহে একটি বাক্স থেকে ২ কেজি করে মধু সংগ্রহ করা যায়। সরিষার ক্ষেত থেকেই ৫০০ টাকা কেজি দরে মধু বিক্রি করছেন তারা। এছাড়া ঢাকা থেকে আসা কয়েকটি কোম্পানীর কাছেও মধু বিক্রি করছেন।

গত ২৫ দিনে অন্তত ১৬ মন মধু সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া মৌমাছি থেকে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া মোম ডাইসে দিয়ে মৌচাক তৈরি করা হয়। সেখানে মৌ-মাছিরা মধু এনে জমা করে। সেই মৌচাক এনে নিজেদের তৈরি একটি যন্ত্রের মধ্যে রেখে চাকতির মাধ্যমে ঘুরিয়ে মধু সংগ্রহ করা হয়। পরে মৌচাক আবার বাক্সে রেখে দেয়া হয়। একটি মৌচাক দিয়ে অন্তত ৪/৫ বছর মধু সংগ্রহ করা যায় বলেও জানিয়েছে টাঙ্গাইলের দুই ভাই। রাকুদিয়ার সরিষা ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা মধু স্থানীয় গ্রামবাসী ছাড়াও দূর দূরান্তের অনেকেই কিনতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন।

চলতি রবি মৌসুমে দেশে ১৪ লাখ ১ হাজার হেক্টরে ২১ লাখ টনেরও বেশী বিভিন্ন ধরনের তেলবীজ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। যা বিগত রবি মৌসুমের চেয়ে প্রায় ১৫ ভাগেরও বেশী। তবে এখনো দেশের মোট চাহিদার ৮০ ভাগেরও বেশী ভোজ্য তেল আমদানী নির্ভর। একটি সূত্রের মতে, প্রতি বছর ভোজ্য তেল আমদানীতেই দেশের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মূদ্রা।

ফলে বরিশাল সহ সারা দেশেই সরিষা সহ বিভিন্ন তেল ফসল আবাদ ও উৎপাদনে সরকার বিশেষ নজর দিচ্ছে। গত বছর দেশে ৮.১২ লাখ হেক্টরের স্থলে এবার কৃষি মন্ত্রণালয় ১২ লাখ হেক্টরে সরিষা আবাদের মাধ্যমে উৎপাদনও ১১.৬১ লাখ টন থেকে ১৭.৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারন করেছে। বরিশালেও চলতি রবি মৌসুমে সরিষার আবাদ ৬৭ হাজার হেক্টর থেকে ৮৩ হাজারে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জিত হবে বলে আশাবাদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই। ফলে উৎপাদনও গত বছরের ৮৪ হাজার ৪শ টন থেকে ১ লাখ ১০ টনেরও বেশীতে উন্নীত হবে বলে আশাবাদী ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল।

অপরদিকে এ অঞ্চলের সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উম্মোচনকারী সয়াবিনের আবাদও এবছর ২৭ হাজার হেক্টর হলেও ইতোমধ্যে সে লক্ষ্য অতিক্রম করায় মৌসুমের শেষে তা ৩০ হাজার হেক্টরে পৌঁছতে পাড়ে বলে আশা করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা। ফলে এবার বরিশাল অঞ্চলে সয়াবিনের উৎপাদন গত বছরের ১.৫৪ লাখ টন থেকে ১.৬০ লাখ টনে উন্নীত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে বরিশাল অঞ্চলে চিনা বাদামের আবাদও গত বছরের ২৩ হাজার হেক্টর থেকে ২৪ হাজার ৭শ হেক্টরে উন্নীত হচ্ছে। ফলে উৎপাদনও ৪৫ হাজার থেকে ৪৯ হাজার টনে উন্নীত হবার ব্যাপারে আশাবাদী ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল।

এদিকে সম্ভাবনাময় এবং অপ্রচলিত সূর্যমুখীর আবাদও বাড়ছে বরিশাল অঞ্চলে। গত বছর বরিশালের ৭ হাজার ৫২০ হেক্টরের স্থলে এবার ৮ হাজার ১৬০ হেক্টরে এ তেল ফসলের আবাদ হচ্ছে। ফলে উৎপাদনও ১৪ হাজার ৩৫৪ টন থেকে এবার প্রায় ১৬ হাজার টনে উন্নীত হতে পারে। যা হবে এযাবতকালের সর্বোচ্চ। এবার সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষকদের মাঝে বেশ কিছু তেল মাড়াই যন্ত্রও সরবরাহ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেল জনস্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট উপকারী। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে সয়াবিনে ৪০-৪৫% আমিষ এবং ১৯-২২% পর্যন্ত তেল থাকে। যেকোন ডাল বা শুটি জাতীয় শস্যের তুলনায় সয়াবিনে আমিষের পরিমাণ বেশী অথচ দাম কম। কৃষি মন্ত্রণালয় চলতি মৌসুমে দেশে প্রায় ৮৬.৫০০ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। উৎপাদন লক্ষ্য রয়েছে ১.৫৯ লাখ টনের।
অপরদিকে সূর্যমুখী একটি উৎকৃষ্ট তেল ফসল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ তেল বীজ গুরুত্বপূর্ণ একটি তেল ফসল হিসেবে বিবেচিত। সূর্যমুখীর বীজে ৪০-৪৫% পর্যন্ত লিনোলিক এসিড রয়েছে অথচ এ তেলে কোন ক্ষতিকারক ইরোসিক এসিড নেই। হেক্টর প্রতি ফলনও ১.৭ থেকে ২ টন পর্যন্ত।

‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারি’ ইতোমধ্যে উন্নত প্রযুক্তির ও উচ্চ ফলনশীল প্রায় ৪০টি জাতের বিভিন্ন তেল বীজ উদ্ভাবন করেছে। যারমধ্যে সয়াবিন ও সূর্যমুখীর জাতও রয়েছে। বারি ইতোমধ্যে ‘সোহাগ-পিবি-১’, ‘বাংলাদেশ সয়াবিন-৪ বা জি-২’, ‘বারি সয়াবিন-৫’ ও ‘বারি সয়াবিন-৬’ নামের একাধিক উন্নতজাত উদ্ভাবন করেছে। এসব উন্নতজাতের সয়াবিনের ফলন হেক্টর প্রতি ১.৮০ টন থেকে সোয়া দুই টন পর্যন্ত। দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটি সয়াবিন চাষের উপযোগী। ফলে নদ-নদী বিধৌত দক্ষিণাঞ্চলের চরাঞ্চলে এ তেল ফসল আবাদের উপযোগী।

তবে ভোজ্য তেল কল প্রতিষ্ঠান দেশে উৎপাদিত সয়াবিন তেলবীজ কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ না করায় দেশে উৎপাদিত এ তেল ফসলের পুরোটাই চলে যাচ্ছে পোল্ট্রি ফিডের কারখানায়। বিভিন্ন পোল্ট্রি ফিড কারখানার নিয়োজিত ফড়িয়ারা বরিশাল সহ উপকূলীয় এলাকার মাঠ পর্যায়ে সয়াবীন বীজ কিনে নিচ্ছে অনেকটা পানির দরে।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *