মো: আল-আমিন (পটুয়াখালী): পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে মার্কেটের স্টল বরাদ্দ নিয়ে বাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে। নামে-বেনামে স্টল পেয়েছেন মেয়র মহিউদ্দিনের চাচাতো ভাই, আপন ভাতিজা, জেলা যুবলীগ সভাপতি, মেয়রের উপদেষ্টাসহ শতাধিক নিজস্ব লোকজন। এতে বঞ্চিত হয়েছেন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তরা ব্যবসায়ী।
তাদের একজন পটুয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. এনায়েত হোসেন।
তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে পটুয়াখালী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শাহজালাল খানের কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ওই স্থানে আমার ওষুধের দোকান ছিল। তবুও মেয়র মহিউদ্দিন আমাকে স্টল না দিয়ে শাহজালালকে দিয়েছেন, তাই আমি শাহজালালের স্টলে তালা মেরেছি।’
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক ব্যবসায়ীর এমন অভিযোগ থাকলেও সংগত কারণে মুখ বন্ধ রেখেছেন তারা।
দৌড়ঝাঁপ করে যারা স্টল পেয়েছেন, তাদের গুনতে হয়েছে স্টল নির্মাণ ব্যয়ের আড়াই থেকে তিন গুণ টাকা। অতিরিক্ত অর্থে স্টল নিতে গিয়ে ঋণসহ পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছে কর্মহীন ব্যবসায়ীরা। আগামী ৯ মার্চ পটুয়াখালী পৌরসভার নির্বাচন প্রেক্ষাপটে অনেকেই মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও নির্মাণে আর্থিক দুর্নীতি ছাড়াও উচ্চ আদালত অবমাননার অভিযোগ উঠেছে মেয়রের বিরুদ্ধে। যদিও এসব বিষয়ে মুখ খুলছে না পৌর কর্তৃপক্ষ।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত আলতাফ আড়তদার, রফিক গাজী, নজরুল ভুইঁয়া, নাসির খন্দকারসহ একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মেয়র মহিউদ্দিন ও তার বন্ধু হাফিজুর রহমান লোকজন নিয়ে শহরের পৌর নিউ মাকের্ট বাজারে কিচেন মার্কেট করার ঘোষণা দিয়ে সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে মৌখিক নির্দেশ দেন। ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে আপত্তি দিলে ৬ অক্টোবর রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ওই অগ্নিকাণ্ডে বাজারের শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আংশিক ও সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। পরে মেয়র ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দ্রুত ভবন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। ওই সময় আগুনে পুড়ে সর্বস্বান্ত হওয়া ব্যবসায়ীদের মেয়রের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না বলে দাবি তাদের।
পরে টানা তিন বছর ধরে স্টল নির্মাণ সম্পন্ন করে স্বজনপ্রীতি শুরু করে স্টল বরাদ্দে। বাজার দর অনুযায়ী ফিটিংস ব্যতীত স্টল নির্মাণে প্রতি স্কয়ার ফুটে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা ব্যয় হলেও বরাদ্দ দিতে নেয়া হচ্ছে তিন গুণ অর্থ।
এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ড ঘটার পরপর বিশাল আকারের এই বাজার থেকে অন্তত ২ লাখ ইটসহ আনুষঙ্গিক অনেক নির্মাণ সামগ্রী উদ্ধার হলেও তা ক্ষতিগ্রস্তদের না দিয়ে ট্রাক ভরে নিয়ে যায় মেয়রের লোকজন।
স্টল নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার আগেই ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল মেয়র খাতে ১৫% সংরক্ষিতসহ ১০৪টি স্টল লটারি পদ্ধতিতে বরাদ্দের ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে ছোট-বড় অন্তত আড়াই শ স্টল নির্মাণ হলেও মাত্র ৪০টি লটারি পদ্ধতিতে বরাদ্দ দেন। বাকি স্টল মেয়র তার পছন্দের ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দ দেন। এতে বাদ পড়ে যান প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা।
অভিযোগকারীরা বলেন, মেয়র মহিউদ্দিনের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদের ছেলে আবিদের নামে এমএস আবিদ মোবাইল জোন, মেয়রের চাচাতো ভাই জেলা বিএনপি নেতা মনির হোসেনের মেয়ে লিমার নামে তুলনা স্টোর, জেলা যুবলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলামের স্ত্রী তাসলিমা পারভীনের নামে মেসার্স জুইন এন্টারপ্রাইজ, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজালাল খান, মেয়রের দুই উপদেষ্টা ফরহাদ জামান বাদল ও কাজী নাসরু তালুকদার, আসলাম ব্যপারী, মজিদ শিকদার, পৌরসভার লাউকাঠি খেয়াঘাটের টোল আদায়কারী রফিকুল ইসলাম রাহাত, মুরগী ব্যবসায়ী খোকন, ডিম ব্যবসায়ী সুভাষ পাল, মনিরুজ্জামান আকন এবং মেয়রের বাসা সংলগ্ন মসজিদের ঈমাম মাওলানা আবদুল কাদেরসহ মেয়রের স্নেহধন্যরা স্টল পেয়েছেন।
অথচ অগ্নিকাণ্ডে এদের কারও কোনো প্রতিষ্ঠান বা দোকান ক্ষতিগ্রস্ত তো দূরের কথা সেখানে কখনোই তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান বা দোকান ছিল না।
এ ছাড়া স্টলের তালিকায় মেয়রের পিএস মিজানুর রহমান এনামুল ও বাসার কাজের লোক মোস্তাফিজুর রহমান বেল্লাল এবং ঘনিষ্ঠজন আব্দুস সালাম আরিফের নাম শোনা যাচ্ছে।
এদিকে পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে স্টল বরাদ্দের তালিকা চাওয়া হলে তারা মেয়রের উপদেষ্টা ফরহাদ জামান বাদলের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। পৌর নির্বাচনে ভোটের রাজনীতি মাথায় রেখে সচ্ছল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের স্টল দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন ক্ষতিগ্রস্তরা। এর মধ্যে ডিম ব্যবসায়ী সুভাষ পাল স্টল নিতে মেয়রকে আনুষ্ঠানিকভাকে সোনার নৌকা উপঢৌকন দিয়েছেন। এ ছাড়া পটুয়াখালী পৌর পরিষদের ১২ জন কাউন্সিলরকে স্টল দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কাউন্সিলর এস এম ফারুক হোসাইন ও কাজল বরন দাসের স্টল চড়াদামে বিক্রি হয়েছে। বাকি কাউন্সিলর ও বিশেষ পদ্ধতিতে পাওয়া স্টলগুলো বিক্রির পাঁয়তারা চালাচ্ছেন তারা।
মামলার বরাত দিয়ে রফিক গাজী বলেন- স্টল বরাদ্দ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করলে মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদকে আদালত নোটিশ করেন। পরে আদালতে হাজির হয়ে ব্যবসায়ীদের স্টল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আদালতে মুচলেকা দেন। ওই মুচলেকায় মেয়র বলেন, দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রাধিকার এবং জমাকৃত অগ্রীম জামানত নতুন সালামির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। অথচ মেয়রের কাছে স্টল চাইতে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে হাইকোর্টে গেছো- এখন হাইকোর্ট ঘর দেবেন, আমার কাছে কোনো ঘর নাই বলে ফিরিয়ে দেন।
রফিক গাজী আরও বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর মেয়রের ডাকে ব্যবসায়ীরা পৌরসভায় গেলে উপস্থিত লোকজনের উপস্থিতিতে স্বাক্ষর নেন মেয়র। পরবর্তীতে ওই স্বাক্ষর জাল-জালিয়াতি করে আদালতে উপস্থাপন করেন।
এসব বিষয়ে মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, পটুয়াখালী পৌরসভা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিউ মার্কেটের কিচেন মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখনও কাজ শেষ হয়নি। ভাইয়ের ছেলে আবিদের নামে কোনো স্টল বরাদ্দ নেই। তা ছাড়া আবিদ মানসিক প্রতিবন্ধী, তার কথা কতটুকু কাউন্টেবল? পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি। তবে কাউন্সিলর ও যুবলীগ সভাপতির স্ত্রীর ব্যাপারে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।