এস এল টি তুহিন, বরিশাল :: সাগরের জোয়ার ক্রমাগত উজানে উঠে আসায় দক্ষিণাঞ্চলে গত কয়েক বছর লবনাক্ততার মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এমনকি এ অঞ্চলের ছোট-বড় ১৩২টি নদ-নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধির সাথে নাব্যতা সংকটে নৌযোগাযোগ ও মৎস্য সম্পদ হুমকির মুখে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে। অপরদিকে অব্যাহত প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে নদ-নদী সমূহে পলি জমে ধারন ক্ষমতা হ্রাসের ফলে বর্ষা মৌসুমে উজানের ঢলের পানি সাগরে প্রবাহের সময় বাড়ছে ভাঙনের তীব্রতাও। সুষ্ঠু প্রবাহের অভাবে ইলিশের বিচরনস্থলের পরিবর্তন ঘটছে। ইলিশ ক্রমাগত গভীর সমুদ্রে চলে যাচ্ছে।
একাধিক নদী গবেষনা প্রতিষ্ঠানের মতে, সীমান্তের ওপার হয়ে সারা দেশের নদ-নদী সমূহের যে পানি সাগরে পতিত হয়, তার ৭৮%-ই মেঘনা, তেতুলিয়া ও বলেশ্ব সহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদী বহন করে থাকে। কিন্তু প্রতি বছরই উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রন সহ যথাযথ সংরক্ষন ও উন্নয়নের অভাবে নদ-নদী সমূহ শুষ্ক মৌসুমে ক্রমাগত ভরাট হয়ে ধারন ক্ষমতা হ্রাসের ফলে বর্ষাকালে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে দেশের নদ-নদীর ভাঙন রোধে এযাবতকালে সর্বাধিক নদী শাসন রোধ প্রকল্প অনুমোদন করেছেন। নদী শাসন প্রকল্প এখনো চলমান।
শুধু দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় গত কয়েক বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশী ব্যয়ে ১৫টি নদী শাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার বেশীরভাগই বাস্তবায়নাধীন। ইতোমধ্যে কয়েকটি ভাঙন রোধ প্রকল্প শেষ হয়েছে বলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু এরপরেও অতি জনগুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকার ভাঙন রোধে এখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রে সমুদ্র সৈকত রক্ষায় একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা সাড়ে ৫শ কোটি থেকে সাড়ে ৭শ কোটি হয়ে সাড়ে ১১শ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এরপর সাড়ে ৭শ কোটিতে নামিয়ে আনা হলেও তা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ফাইলে আটকে আছে।
ড্রেজিং ও ভাঙন রোধে সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবে এখনো দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের আশীর্বাদ ১৩২টি নদ-নদী অনেকটাই দুঃখে পরিনত হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের ৫শ কিলোমিটারে নাব্যতা সংকট ভয়াবহ ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। একই কারণে প্রায় ৩ লাখ টন মাছ উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যতও ঝুঁকির মুখে। অথচ সারা দেশের আহরিত ইলিশের প্রায় ৭০ ভাগই উৎপন্ন হয়ে থাকে দক্ষিণাঞ্চলে ।
বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদীর ভয়াবহ ভাঙনে সকাল বেলার আমীরকে সন্ধ্যায় ফকিরে পরিনত করছে। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা সংকটে নৌ যোগাযোগ বিপর্যস্ত হচ্ছে।
সীমান্তের ওপারে শুষ্ক মৌসুমে বিবেকহীন প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে নদ-নদী বহুল দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথে নাব্যতা সংকট ক্রমাগত ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। একই সাথে সাগরের লবনাক্ত পানি ১শ কিলোমিটার উজানে বরিশাল ছাড়িয়ে আরো ৫০ কিলোমিটার উত্তরে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলার মেঘনা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে।
দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর ওপরই দেশের ৩টি সমুদ্র বন্দর সহ সারা দেশের সাথে নৌ যোগাযোগ নির্ভরশীল। এমনকি পায়রা সমুদ্র বন্দরটি সম্পূর্ণভাবেই দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদী নির্ভর। মেঘনা সহ বড় কয়েকটি নদ-নদীর নাব্যতা সংকটে পায়রা ও মোংলা বন্দর সহ দক্ষিণাঞ্চলের সাথে চাঁদপুর হয়ে ঢাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের এবং চট্টগ্রামের নৌ যোগাযোগে ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার প্রশস্ত ভাটি মেঘনায় ডুবো চরে ফেরি সহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বিঘ্নিত করে। অথচ এ নৌপথটির ওপরই চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সারা দেশেরই নৌ যোগাযোগ নির্ভরশীল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্রের মতে ২০০৬ সালের জানুয়ারীতে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা ছিল ৬১০-৬৩০ পিপিএম। সেখানে ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে তা ৯১০ পিপিএম-এ পৌঁছে। ২০১৮ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নীত হলেও ’১৯ সালে একই নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা আবার ৯শ পিপিএম-এ বৃদ্ধি পায়। ২০২০-এর জানুয়ারীতেও লবনাক্ততার মাত্রা ছিল প্রায় ৯শ পিপিএম-এর কাছে। তবে এছর এখনো লবনাক্ততার মাত্রা বিপদ সীমার নিচেই রয়েছে।
২০২১-এর এপ্রিলের শুরু থেকে বরিশালের কীর্তনখোলায় লবনাক্ততার মাত্রা ১ হাজার পিপিএম অতিক্রম করে। উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনসহ স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে ২০২১-এর শুষ্ক মৌসুমে সাগরের নোনা পানি গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীতে পৌঁছে সর্বকালের সর্বোচ্চ ২১শ পিপিএম লবনাক্ততা সনাক্ত হয়। যা ২০১৬ সালে ছিল ১২শ পিপিএম। আমাদের কৃষি ও মৎস্য সম্পদ সহ মানব দেহের জন্য সহনীয় লবনাক্ততার মাত্রা ৬শ পিপিএম।
উজানে বিবেকহীন প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনে বিগত ২০২১ ও ২০২২ সালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে নদীর দেশ দক্ষিণাঞ্চলের নদী সমূহ ক্রমাগত তার চরিত্র বদলাচ্ছে। গতবছরও মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের ব্যাপক ঘাটতির পরে শরৎ পেরিয়ে হেমন্তে প্রবল বর্ষনে উঠতি আমন ও আগাম রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতির সাথে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারন করে। যা কৃষি ও মৎস্য সম্পদ সহ সুস্থ্য মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে দাবী পরিবেশবীদদের।