শিরোনাম

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উত্তাল- সংগঠিত হতে শুরু করে মুক্তিপাগল মানুষ

Views: 42

বরিশাল অফিস :: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর পরই উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বরিশাল।

সংগঠিত হতে শুরু করেন এতদাঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষ। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বরিশালে চালু হয় ‘স্বাধীন বাংলার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রথম সচিবালয়’। যা একমাস কার্যকর ছিলো। সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। যুদ্ধও পরিচালিত হয়েছে স্বাধীন বাংলার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রথম সচিবালয় থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্য-অর্থ সংগ্রহ ও সরবরাহ করা হতো ওই সচিবালয়ের মাধ্যমে।

সে সময় বরিশালে পত্রিকা আসতো একদিন পর। তাই বঙ্গবন্ধু কি বলেছেন, ঢাকার খবর কি? এসব জানতে স্থানীয় নেতাদের বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত ভিড় করতেন মুক্তিপাগল মানুষ। বিশেষ করে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও এমএলএ নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসা হয়ে উঠেছিলো মুক্তিপাগল মানুষের সমাবেশস্থল।

শহরের পেশকার বাড়ির আঙ্গিনায় মানুষের ঠাঁই দেয়া একসময় অসম্ভব হয়ে পরে। পেশকার বাড়ির অপরপ্রান্ত হেমায়েত মঞ্জিলের সামনে এবং কৃষি অফিস চত্বরে মানুষ অবস্থান করতো মধ্যরাত পর্যন্ত। প্রচন্ড উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে পরবর্তী নির্দেশ পাওয়ার জন্য অস্থির ছিলেন বরিশালের মুক্তিকামী মানুষ। বরিশাল শহরে স্থায়ী মঞ্চ করে প্রতিদিন চলতে থাকে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গণসংগীত।

বরিশাল অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও তৎকালীন এমএলএ নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের আত্মজীবনীমূলক বইয়ে স্বাধীন বাংলার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রথম সচিবালয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটি স্থাপন করা হয়েছিল বর্তমান বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে পরে স্থাপন করা হয়েছে ‘স্বাধীন বাংলার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রথম সচিবালয়’এর একটি স্মারক।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তৎকালীন অন্যতম সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রদীপ কুমার পুতুল বলেন, আমি তখন বরিশাল ল’ কলেজে আইনের ছাত্র ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষনের পর আমাদের কাছে (ছাত্রসমাজ) এটাই মনে হলো, পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ অনিবার্য। এটা আর রোধ করা সম্ভব নয়। আর সেসময় আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসা ছিলো আমাদের কন্ট্রোল রুম। সেখান থেকেই আমাদের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হতো।

রাত-দিন ২৪ ঘন্টাই ছিলো তার বাড়িতে আমাদের অবস্থান। তিনি আরও বলেন, যেহেতু বঙ্গবন্ধু ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে’ বলেছেন। তাই বরিশালেও প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করে। যদিও যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের তখন কোন ধারণা ছিলোনা। শুধু দেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে আমরা কাজ শুরু করে দেই। প্রায় প্রতিদিনই মিটিং মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করি।

এতদাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু জনকণ্ঠকে বলেন, ৭ মার্চের ভাষনের পর অগ্নিঝরা মার্চ মাসেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদিয়ে বরিশালেও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করা হয়। প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠণ করা হয়েছিলো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই যুদ্ধের প্রস্তুতি চলে। পরবর্তীতে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুুর স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যদিয়ে চূড়ান্তরূপে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা হয়।

 

আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যোগ দেয় মহান মুক্তিযুদ্ধে। তিনি আরও বলেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর থেকে সাধারণ মানুষকে আন্দোলনের মধ্যে রাখার জন্য সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায় অনুষ্ঠিত হতো সভা, সমাবেশ, গণসঙ্গীত, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নামতো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রোতারা শ্রবণ করতেন রক্তে আগুন জ্বালা সেসব গান ও কবিতা। স্বাধীনতায় উজ্জীবিত করা সেসব গণসঙ্গীতে উদ্বেলিত হতো সাধারণ মানুষ। সেসব গানের মধ্যে গণসঙ্গীত শিল্পী আবু আল সাঈদ নান্টুর ‘জয় স্বাধীন বাংলা’ গানটি সব সভার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার ঘোষণায় সর্বস্তরের জনতার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় করণীয়।

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম মঞ্জু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন। তার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চল’ বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের শেষদিকে যা বলেছেন তার নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট করেই বোঝা যাবে ওইদিনই (৭ মার্চ) বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে ৭ মার্চের ভাষনের পর পরই বরিশালে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ প্রস্তুতি।

নুরুল ইসলাম মঞ্জু তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তার সাথে দেখা করে মেজর জলিলের দেয়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রস্তুতিমূলক কিছু তথ্য জানিয়ে ওইদিনই আবার বরিশালের উদ্দেশে ফিরে আসি। ওইদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বসে মঞ্জু সাথে দেখা হয়েছিলো কর্নেল ওসমানী ও ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হকের। বরিশাল ফিরে ২৫মার্চ দিনভর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রস্তুতি সভা করা হয়।

২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে আকস্মিকভাবে ট্রাঙ্কলযোগে ছাত্রলীগ নেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী তাকে (মঞ্জু) জানান, ঢাকায় হানাদার বাহিনী হিংস্র হায়নার মতো রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিলখানা ইপিআরের হেড কোয়ার্টারসহ নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করেছে। তাৎক্ষনিক মঞ্জুরের বাসভবনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও নির্বাচিত জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (শহীদ), মহিউদ্দিন আহম্মেদ, আমির হোসেন আমু (সাবেক শিল্পমন্ত্রী) এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মালেক খানসহ নেতাকর্মীদের নিয়ে জরুরি সভা করা হয়।

 

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাৎক্ষণিক এ্যাডভোকেট সরদার জালাল উদ্দিনকে (শহীদ) নির্দেশ দেয়া হলো-রাজধানীতে পাকিস্তানী বাহিনীর পৈশাচিক ঘটনা মাইকিং করে শহরে প্রচারের জন্য। পাশাপাশি বরিশাল শহরবাসীকে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ এবং যাদের লাইসেন্সভুক্ত অস্ত্র আছে তাদের অস্ত্র আমার (মঞ্জু) বাড়িতে অবস্থিত কন্ট্রোল রুমে জমা দেয়ার জন্য।

মঞ্জু তার বইতে আরও উল্লেখ করেছেন, ওইদিনই (২৫ মার্চ) ভোররাতে বরিশালের একদল সাহসী মুক্তিকামী তরুণকে নিয়ে ছুটে যাই বরিশাল পুলিশ লাইনে। তৎকালীন জেলা প্রশাসক আইয়ুবুর রহমান, পুলিশ সুপার ফখরুদ্দিন আহম্মেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আজিজুল ইসলাম, ডিএসবির এসআই বাদশা মিয়া, হাবিলদার আকবরসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যর সহযোগিতায় আমরা পুলিশ বাহিনীর অস্ত্রাগারে রক্ষিত সব অস্ত্র বের করে নিয়ে শহরের বগুড়া রোডের পেশকার বাড়ি এলাকার আমার বাড়িতে আসি। ওই বাড়িতেই গড়ে তুলি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রাগার। পেশকার বাড়ির পুকুরে অজু করে আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের আমি শপথবাক্য পাঠ করাই। এরপর ২৬ মার্চ সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে অস্ত্র বিতরণ করি।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, দ্রুত বরিশাল শহরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু করতে মেজর জলিলের কাছে খবর পাঠাই। একইদিন বাড়ির সামনে সদর গার্লস স্কুলে প্রতিষ্ঠা করা হয় “স্বাধীন বাংলার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রথম সচিবালয়”। গঠণ করা হয় একটি শক্তিশালী বিপ্লবী পরিচালনা পরিষদ। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ওই পরিষদের মাধ্যমেই দক্ষিণাঞ্চলের সবকিছু পরিচালিত হতো। ১৭ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী প্রথম বরিশালে আক্রমণ করে এবং ২৬ এপ্রিল বরিশাল শহরের দখল নেয়।

ফলে সদর গার্লস স্কুলে স্থাপিত স্বাধীন বাংলার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রথম সচিবালয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, হাজার-হাজার প্রাণ ও মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর পাকহানাদারের কবল থেকে দখলমুক্ত হয় বরিশাল।

image_pdfimage_print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *