বরিশাল অফিস : : জানাজা, ক্রিড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিম্বা মাহফিলের প্রধান অতিথি হিসেবে গ্রামের সাধারণ মানুষের সাথে সম্পৃক্ত হবার জোর প্রতিযোগিতা চলছে বরিশাল সদর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে। যদিও সাধারণ মানুষের এ নিয়ে খুব একটা ভাবান্তর নেই। এই নির্বাচন নিয়ে চা দোকানেও নেই কোনো আলোচনা। এমনকি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করার পর সোজা সরল উত্তর – পেটনীতি কইরা বাচিনা, উপজেলায় আর কি? জাতীয় নির্বাচনেইতো উপজেলা লেখা আছে। যানতো ভাই। এমন আচরণ চন্দ্রমোহন ও চাঁদপুরা ইউনিয়নের বাজারে।
আবার টুঙ্গিবাড়িয়া, শায়েস্তাবাদ, চরবাড়িয়া ও চরমোনাই এলাকার গ্রামের সাধারণ মানুষের মুখে এখন নির্বাচন মানেই চরম বিরক্তি। এ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহ না থাকলেও সোমালিয়া থেকে বাংলাদেশের নাবিকরা উদ্ধার হয়েছে কিনা, পাকিস্তানের ইমরান খান সরকারে আসবে কিনা জানার আগ্রহ গ্রামবাসীর। কেউ কেউ আবার বাজারের দরে বিএনপির সিন্ডিকেট কীভাবে করলো, দেশে এতো আত্মহত্যা কেন হচ্ছে, জাহাঙ্গীর নগর ও জগন্নাথের আত্মহত্যা হইলো কেন? এমন অসংখ্য প্রশ্ন তোলেন গ্রামের অশিক্ষিত- অর্ধমূর্খ কৃষকেরা।
সরজমিন, বরিশাল সদর উপজেলার নির্বাচনী প্রস্তুতি ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরার চেষ্টায় (১৮ মার্চ) শনিবার এমন পরিস্থিতিতে পরতে হয়েছিলো টুঙ্গিবাড়িয়ার লাহারহাট ও চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের চন্দ্রমোহন বাজারে। বরিশাল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে এবার মনিরুল ইসলাম ছবি, মাহমুদুল হক খান মামুন, এসএম জাকির এবং মাহবুবুর রহমান মধু নামে চারজনের ব্যানার পোস্টার ও প্রচারণা চোখে পড়ে। কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী এলাকাসহ ওপারে ঝুলছে এসব ব্যানার পোস্টার।
বরিশাল সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ১৪৭টি গ্রামকে ঘীরে চেয়ারম্যান পদে এখন পর্যন্ত চারজনের প্রচারণা চোখে পড়ে। সকলের চেষ্টা এই উপজেলার প্রায় সোয়া দুই লক্ষ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার। এদের মধ্যে ভোটার সংখ্যা রয়েছে প্রায় দুই লক্ষ। তবে ২০১১ সালের জনসংখ্যা পরিসংখ্যানে মোট লোকসংখ্যা ১,৯৮,৭৩৯ জন, পুরুষ ৯৭,৭৩২ জন, মহিলা ১,০১,০০৭ জন উল্লেখ রয়েছে। একই হিসেবে ভোটার সংখ্যা ১,২০,৫৮১ জন,পুরুষ ভোটার ৫৯,৪৫৫।
তবে আপডেট করা হলে এ সংখ্যা এখন দ্বিগুণ হবে বলে জানান জনপ্রতিনিধিরাই। এ অঞ্চলের বরাবরই নারী ভোটার বেশি। তাই জাতীয় বা স্থানীয় উভয় নির্বাচনেই নারীদের ভোট বেশি গুরুত্ব বহন করে বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যানরা।
বরিশাল এক বা সদর আসনের ১০ ইউনিয়নের মধ্যে নদীর ওপারে চরকাউয়া, চাঁদপুরা, চরমোনাই, চন্দ্রমোহন এবং টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের প্রায় সব জনপ্রতিনিধি (চেয়ারম্যান) জানালেন, তারা নিজেদের এলাকার সড়ক ও ব্রীজের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাচ্ছেন না। অনেক সড়ক, ব্রীজ ও কালভার্টের কারণে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। এগুলো নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার ও স্থানীয় সংসদ সদস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এর কাছে ছুটোছুটি করছেন। তাই উপজেলা চেয়ারম্যান নিয়ে এখনই কিছু ভাবছেন না বলে জানান বেশিরভাগ চেয়ারম্যান।
তারা বলেন, এখনোতো তফশিল ঘোষণা হয়নি। যারা প্রচারণা চালাচ্ছেন তাদের অনেকেই হয়তো ততদিনে উইড্র হয়ে যাবেন বলে জানান টুঙ্গিবাড়িয়ার চেয়ারম্যান নাদিরা রহমান। তার এলাকায় বদিউল্লাহ, শালুকা ও চর কেউটিয়া গ্রামে ফুলতলা নদীর উপর তিনটি ব্রীজ নির্মাণের দাবীতে আন্দোলন করছে গ্রামবাসী। যা নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন চেয়ারম্যান নাদিরা রহমান।
তিনি বলেন, যেহেতু সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক চর কেউটিয়াতে একটি ব্রীজের ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে একই ইউনিয়নে আরো দুটি ব্রীজ কি করে চাইবো?
এদিকে চরমোনাই ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ বেশিরভাগ গ্রামেই কোনো উন্নয়ন ছোঁয়া লাগেনি। যতটুকু উন্নয়ন তার সবটাই চরমোনাই মাহফিল ময়দান ও মাদ্রাসা এলাকায়। আশেপাশের গ্রামগুলোতে এখনো মাটির সড়ক চোখে পড়ে
চন্দ্রমোহন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক অবশ্য চারজন প্রার্থীকেই সময় দিয়েছেন দাবী করে বলেন, মনিরুল ইসলাম ছবি সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী, আবার এসএম জাকির যখন এসেছেন তখন ইউনিয়ন পরিষদের সব সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। আবার মাহমুদুল হক খান মামুন এসেছিলেন একটি ক্রিড়া প্রতিযোগিতার প্রধান অতিথি হিসেবে। এলাকার মানুষের সাথে আমিও ছিলাম সেখানে।
চাঁদপুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদ হোসেন বললেন, বরিশাল ৫ আসনের সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এর নির্দেশনার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। চাঁদপুরা ইউনিয়ন বাসী জাহিদ ফারুকের সমর্থন যেদিকে সেদিকেই তারা থাকবে বলে জানান চেয়ারম্যান জাহিদ হোসেন।
চরকাউয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ছবি নিজেই সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পরপর চারবারের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানান মনিরুল ইসলাম ছবি। তিনি বলেন, সাংগঠনিক ভাবে আমার অবস্থান প্রচণ্ড শক্ত রয়েছে। তাই মানুষের ভোটও আমি পাবো।
এদিক দিয়ে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান মধু। লাহারহাটের গ্রামে প্রচারণারত মধুর দাবী ১০ ইউনিয়নের ১৪৭টি গ্রামের প্রতিটি ঘরে আমি গিয়েছি। যতটুকু পেরেছি ততটুকু সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছি। তারপরও সংবাদমাধ্যমগুলোতে অনেকের নাম লেখা হয়, আমার নাম লেখা হয়না।
তিনি অভিযোগ তুলে বলেন, সাংবাদিকরাতো সবাই জাকিরের লোক। কেউ কেউ অবশ্য প্রতিমন্ত্রীর সমর্থন যেদিকে সেদিকে থাকবেন। তারউপর খান মামুন এর অঢেল টাকাও রয়েছে। তিনি তা দিয়ে দান দক্ষিণা করে প্রচারণা চালাচ্ছেন বলে জানান মধু। তিনি আরো বলেন, দৈনিক মতবাদ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক এসএম জাকিরতো শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হবার সুযোগে সাংবাদিকদের বড় একটা অংশের সুনজরে রয়েছেন। যে কারণে তার নিজের পত্রিকাসহ অনেক পত্রিকার প্রভাব বিস্তার হচ্ছে ইউনিয়ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও ইউপি সদস্য মহলে। তাই তার জনসভায় সব চেয়ারম্যান মেম্বার উপস্থিত থাকতে বাধ্য হয় বলে জানালেন ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমান মধু।
যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক কাউন্সিলর এসএম জাকির বলেন, মানুষেরা জানেন আমি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। আমাকে ভোট দিলে কারো প্রতারিত হবার ভয় নেই। আমি দুই লক্ষ ভোটারের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করবো বলে জানান এসএম জাকির।
অন্যদিকে প্রকাশ্যে প্রতিমন্ত্রীর ছবি সমেত ব্যানার পোস্টার ঝুলিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন মাহমুদুল হক খান মামুন এবং মধু দুজনেই। এই দুজনের মধ্যে খান মামুন প্রচার প্রচারণায় এবং প্রতিটি ইউনিয়নের স্কুল কলেজ, মসজিদ মাদ্রাসার উন্নয়নে, ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে অবদান রাখছেন। এপারে কাশীপুর, কড়াপুর, চরবাড়িয়া ও শায়েস্তাবাদের প্রতিটি সড়কের মোড়ে মাহমুদুল হক খান মামুন এর ব্যানার পোস্টার লক্ষ করা গেছে। যা তাকে স্থানীয়ভাবে আলোচিত করে তুলছে। তার সম্পর্কে লোকেরা জানান, ত্যাগী নেতা তিনি। রাজনৈতিক জীবনে দল থেকে প্রাপ্তির খাতা শূন্য হলেও জনগণের কাছ থেকে অনেক ভালবাসা পেয়েছেন তিনি।
বরিশালের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলেন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ তৎপরবর্তী প্রায় সব আন্দোলন সংগ্রামে মাহমুদুল হক খান মামুন এর ভুমিকা সবচেয়ে প্রশংসনীয় ছিল। তার কারণেই বরিশালের রাজনৈতিক যে পরিবর্তন তা চাক্ষুষ হচ্ছে। অথচ এই মানুষটি বঞ্চিত থেকে গেলেন সবসময়।
তবে বরিশাল মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন বলেন, কোনো পদপদবি মোহে নয়, সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করা, তাদের বিপদে এগিয়ে আসা, ছোটখাটো উপকার এসব আমরা পারিবারিক ভাবেই করছি। কারণ বংশপরম্পরায় আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। আমার বাবা প্রয়াত শামসুল হক এই বরিশালের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর ছিলেন। কতশত মানুষের ঠিকানা দিয়েছেন তিনি এই বরিশালে আমার বড় ভাই শহীদুল্লাহ আওয়ামী লীগ করতেন। ১৯৮১ সাল থেকে আমি বিএম কলেজে ছাত্রলীগের ভিপি ছিলাম। তিল তিল করে আজকের এই অবস্থানে এসেছি। যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে আছি। জেল খেটেছি। ২০০৮, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিতে চেষ্টা করেছিলাম। দল থেকে মনোনয়ন পাইনি। এবার কেন্দ্রীয় সহ স্থানীয় শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুরোধে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীতা করছি। এভাবে হলেও বরিশালবাসীর সেবা করার একটা সুযোগতো পাবো। আশাকরি গ্রামবাসী আমাকে সে সুযোগ দেবেন বলে জানান খান মামুন।
আগামী ৪ মে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানালেন বরিশালের নির্বাচন পরিচালনা কর্মকর্তাওয়াহিদুজ্জামান মুন্সি। তিনি বলেন, ৪ মে থেকে ২৫ মে সারাদেশের উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সেই ধারাবাহিকতায় বরিশালে প্রথম পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে বলে জানান তিনি।